পঞ্চায়েত দখল নিয়েই একের পর এক খুন

পঞ্চায়েত দখলে থাকলেই ক্ষমতার রাশ থাকবে হাতে— দক্ষিণ দামোদর এলাকার দামোদর ও গন্ধেশ্বরীর ধার বরাবর বালি খাদানে কান পাতলেই শোনা যায় এ কথা। খণ্ডঘোষে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে তিন তৃণমূল কর্মীর খুনের ঘটনায় আবারও সেই চেনা ছকই প্রকাশ্যে চলে এল। গত দেড় মাসে ওই এলাকায় ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে এ নিয়ে পাঁচ জন খুন হলেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৫ ০১:৩১
Share:

গ্রামে টানা চলছে পুলিশের টহল।

পঞ্চায়েত দখলে থাকলেই ক্ষমতার রাশ থাকবে হাতে— দক্ষিণ দামোদর এলাকার দামোদর ও গন্ধেশ্বরীর ধার বরাবর বালি খাদানে কান পাতলেই শোনা যায় এ কথা। খণ্ডঘোষে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে তিন তৃণমূল কর্মীর খুনের ঘটনায় আবারও সেই চেনা ছকই প্রকাশ্যে চলে এল।
গত দেড় মাসে ওই এলাকায় ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে এ নিয়ে পাঁচ জন খুন হলেন। একটিতে সিপিএম-তৃণমূল সংঘাত থাকলেও, বাকি চারটি খুনের নেপথ্যেই রয়েছে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। তৃণমূলের একাংশ স্বীকারও করে নিচ্ছেন, শুধু বালি খাদানের দখলই নয়, গাছ কাটার টাকা, চালকলের টাকা সবই রয়েছে এর পিছনে। মে মাসে দক্ষিণ দামোদরের মাধবডিহি থানার রায়না ২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আব্দুল আলিম ওরফে বাবলু খুন হন। গত রবিবার খণ্ডঘোষের ওঁয়ারি গ্রামে তৃণমূলের ব্লক সভাপতি অলোক মাজির অনুগামী মহম্মদ জামালউদ্দিন, শেখ সওকত ও শেখ আইনাল লায়েককে পিটিয়ে খুন করা হয়। এই চারজনের পরিবারেরই অভিযোগ, তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে তাঁরা খুন হয়েছেন। বেআইনি বালি খাদানের তোলাবাজি-সহ পঞ্চায়েতে দুর্নীতি রুখতে গিয়ে দলের কোন্দলেই এই ঘটনা বলেও তাঁদের দাবি।
এমনকী খণ্ডঘোষের ঘটনার পিছনে পুলিশ যে রিপোর্ট তৈরি করেছে তাতেও উল্লেখ করেছে, স্থানীয় খণ্ডঘোষ পঞ্চায়েত শাসকদলের কোন গোষ্ঠীর হাতে থাকবে তা নিয়েই গোলমালের জেরে তিন জনকে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে। আর তৃণমূলের রায়না ২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আব্দুল আলিমের খুনের পিছনে যে সরাসরি গন্ধেশ্বরী নদী থেকে বেআইনি বালি খাদান থেকে তোলাবাজির ‘বখরা’ নিয়েই খুন তা বলে উচ্চমহলে রিপোর্ট দিয়েছে পুলিশই।

Advertisement

তৃণমূলের একাংশের দাবি, সিপিএম আমলে দামোদর ও গন্ধেশ্বরীতে একের পর এক বেআইনি বালিখাদান ছিল। কিন্তু সেই সব খাদানে সিপিএমের এক নেতার ‘কন্ট্রোল’ থাকার জন্য বাম আমলে ছোট-খাটো দু’একটা গণ্ডগোল ছাড়া বিশেষ কিছু হয়নি। বরং ১৯৯৩ সালে রায়না ২ এর পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি থাকাকালীন উদয় সরকারের উপর হামলা চালিয়েছিল বালি মাফিয়ারা। উদয়বাবু দাবি করেছিলেন, “রাজস্ব বাড়ানোর জন্য ব্যাপক অভিযান চালানো হয়েছিল। তার জন্যই আমার উপর রাগ পড়েছিল বালি মাফিয়াদের।” তৃণমূল নেতৃত্বেরও দাবি, এরপরে আর সে রকম কোনও ঘটনা ঘটেনি। ২০০৮ সালে বাম আমলে শেষ দিকে রায়নার হিজলনাতে দামোদরের বালি খাদানকে কেন্দ্র করে রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সেই সময় শুধু মাত্র হিজলনাতেই তিনজন খুন হয়েছিলেন। সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য অমল হালদার বলেন, “আমরা ওই সময় ওই এলাকার এক পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ও দলের লোকাল কমিটির সদস্যের বিরুদ্ধে বালি মাফিয়াদের সঙ্গে যোগ রয়েছে বলে জানা যায়। তাঁকে বহিষ্কার করা মাত্র তৃণমূল লুফে নেয়। তারপরেই ওই এলাকায় বালি খাদানকে দখলকে ঘিরে খুনখারাপি হতে শুরু করল।”

তবে বালির খাদান নেপথ্যে থাকলেও মূল হচ্ছে পঞ্চায়েতের দখল, শাসকদলের লোকেরা অন্তত সেরকমই জানাচ্ছেন। কারণ পঞ্চায়েতের দখল থাকলে তবেই বালির খাদানের দখল নেওয়া যাবে, নদীর বাঁধে থাকা গাছ বেআইনি ভাবে কেটে বিক্রি করা যাবে। আবার পঞ্চায়েত দখলে থাকলে তবেই না দক্ষিণ দামোদরে থাকা কয়েক’শ চালকল মালিকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের তোলা আদায় করা যাবে। তৃণমূলের জেলা স্তরের এক নেতা বলছিলেন, “বর্জ্য নিকাশির বেহাল বলে পঞ্চায়েত কর্তারা চালকলগুলির উপর নানা রকম শংসাপত্র আটকে দেয়। এই সব ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে পঞ্চায়েত কর্তাদের মোটা অঙ্কের টাকা দেওয়ার রেওয়াজ চালু হয়েছে।” এই নেতাই আবার বলেন, ‘‘দক্ষিণ দামোদর এলাকায় অন্তর্দ্বন্দ্বের পিছনে বালি খাদানের কথা উঠে আসলেও মূল কিন্তু পঞ্চায়েতের ক্ষমতা দখল। যার মাধ্যমে এক মুঠিতে সব ক্ষমতায় চলে আসবে। সে জন্যই তো গত কয়েক মাসে মন্তেশ্বরে ১০ জন তৃণমূল কর্মী খুন হয়েছেন!”

Advertisement

দক্ষিণ দামোদরের তৃণমূল সূত্র বলছে, খণ্ডঘোষের শাঁকারি ১, শশঙ্গা, লোধনা গ্রাম পঞ্চায়েতে ৪২টি বালি খাদান রয়েছে। যার মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটা ছাড়া সবকটাই বেআইনি। অভিযোগ, কামালপুকুরের এক বালি মাফিয়ার মাধ্যমে ওই বালি খাদানগুলি ‘দখলে’ রেখেছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন। পরে পঞ্চায়েতগুলির ‘দখল’ ধীরে ধীরে আলগা হয়ে যাচ্ছিল তৃণমূলের প্রাক্তন ব্লক সভাপতি, তৃণমূল কর্মী খুনে অভিযুক্ত মোয়াজ্জেম হোসেন ওরফে মনির। সেই জায়গায় বর্তমান ব্লক সভাপতি অলোক মাজির প্রভাব বাড়ছিল। খণ্ডঘোষ পঞ্চায়েতেও ঢুকতে পারছিলেন না মোয়াজ্জেম গোষ্ঠীর লোকেরা। উজলপুকুরে একটি দলীয় দফতরকে বন্ধ করে রেখেছিল মোয়াজ্জেম হোসেন। এই সব ঘটনাই রাস্তা তৈরি করে দেয় রবিবার রাতের সংঘর্ষের। রায়নাতেও প্রায় তিরিশটা, জামালপুরের দুটো গ্রাম পঞ্চায়েতে ১৫টা ও মাধবডিহির গন্ধেশ্বরীতে প্রায় ১২টা বালি খাদান রয়েছে। এই মাধবডিহির বালি খাদানকে ঘিরেই দলের কর্মীর হাতে খুন হয়েছেন রায়না ২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি।

তালা বন্ধ অভিযুক্ত মোয়াজ্জেমের বাড়ি। নিজস্ব চিত্র।

সিপিএমের নেতা অমল হালদারের অভিযোগ, “তৃণমূলের ক্ষমতাসীন একটা অংশ কয়েকমাসের মধ্যে চোখের সামনে বাড়ি-গাড়ি করছে। আর তাতেই অন্য অংশ ক্ষুব্ধ হচ্ছে। তার ফলেই এই খুনোখুনি। মনে রাখা দরকার, বালি মানেই কাঁচা পয়সার রোজগার। যার কোনও হিসেব নেই।” তৃণমূলের একটা অংশও জানাচ্ছে, বালি খাদান থেকে মূল রাস্তা পর্যন্ত যত গ্রাম রয়েছে, সব গ্রামের রাস্তার ধারেই তৃণমূলের অফিস খুলে ট্রাক মালিকদের কাছ থেকে ‘তোলা’ আদায় করা হয়। এক-একদিনে তিরিশ-চল্লিশ হাজার টাকা পর্যন্ত ‘তোলা’ আদায় করা হয় বলে জানা যায়। দক্ষিণ দামোদর এলাকার তৃণমূল অন্যতম সংগঠক তথা বর্ধমান আদালতের আইনজীবী সদন তা বলছিলেন, “পরিস্থিতি যে দিকে এগোচ্ছে, তাতে দলের উচ্চ নেতৃত্বের এখনই উচিত হস্তক্ষেপ করা। তা না হলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার।”

তবে তৃণমূলের জেলা সভাপতি তথা প্রাণী বিকাশ দফতরের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ বলেন, “পরিস্থিতি কঠোর হাতে মোকাবিলা করার জন্য আমরা এগোচ্ছি। সমস্ত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দলগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement