কিরণময় নন্দ।
কংসাবতীর পাড়ে মুগবেড়িয়া থেকে বছরের পর বছর জিতে এসে রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। সে পূর্বাশ্রমের কথা। বাংলার পাটই প্রায় চুকে গিয়েছে এখন। কিন্তু মাছের প্রবৃত্তি তিনি ভোলেননি! কোথায় গভীর জলে থাকতে হবে, কোথায় ভেসে উঠতে হবে, এ সব কৌশল এখন গোমতীর তিরে কাজে লাগছে এক বঙ্গসন্তানের!
বাবা মুলায়ম সিংহ যাদব এবং ছেলে অখিলেশ, দুই শিবিরেই যাতায়াত করে মীমাংসা সূত্র বার করার চেষ্টায় নেমেছেন কিরমণয় নন্দ। সেই পথেই ধরে রাখছেন নিজের জায়গা। গৃহযুদ্ধে সমাজবাদী পরিবার যখন আড়াআড়ি বিভক্ত, কিরণময়বাবু কিন্তু দুই শিবিরেই ঘরের লোক! লখনউয়ে প্রকাশ্য মঞ্চে শিবপাল সিংহের কথার প্রতিবাদ করে বলছেন, আপনি ঠিক বলছেন না! পরে আবার তাঁর সঙ্গেই বৈঠকে বসছেন! রাত পর্যন্ত আলোচনা করছেন মুলায়মের সঙ্গে। পরে রাতেই চলে যাচ্ছেন দিল্লিতে অখিলেশ শিবিরের অন্যতম মুখ রামগোপাল যাদবের কাছে। মাছের মতোই অনায়াস সাঁতারে!
পদাধিকারে সমাজবাদী পার্টিতে তিনি মুলায়মের পরেই। দলের একমাত্র সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি। রাজ্যসভার সাংসদও। পশ্চিমবঙ্গে বাম জমানা যখন ফুরিয়ে আসছে, রায়গঞ্জে হেরে যাওয়ার পরে মুলায়মের হাত ধরেই উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে সরে গিয়েছিলেন কিরণময়বাবু। মুলায়মের সঙ্গে হৃদ্যতা তাঁর এখনও অটুট। আবার অমর সিংহের বিরোধিতা করে অখিলেশ শিবিরের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে নিয়েছেন। প্রশ্ন করলে বলছেন, ‘‘আরে, কোন পরিবারে বাপ-ব্যাটার মধ্যে ঝগড়া হয় না? আবার সব মিটেও যায়। জীবনে তো কম দেখলাম না!’’ বাংলায় বামফ্রন্টের রাজনীতিতে পোড় খাওয়া কিরণময়বাবু জানেন, কোনও শিবিরে নাম লিখিয়ে ভিন্ রাজ্যে পুনর্বাসনের রসায়ন ঘেঁটে ফেলার কোনও অর্থ হয় না। তার চেয়ে ভারসাম্যই ভাল!
ভারসাম্যের খেলাও চলছে বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে! মুলায়মের ভাই তথা উত্তরপ্রদেশে দলের সভাপতি শিবপাল সরাসরি অখিলেশের বিরুদ্ধে বলেছিলেন, ‘‘যখন নেতাজি’র (মুলায়ম) কথা মতো মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে (অখিলেশ) কথা বলতে গিয়েছিলাম, তখন উনি বলেন, আমি নতুন আ়ঞ্চলিক দল তৈরি করব। আমার সঙ্গে নন্দাজি (কিরণময়) গিয়েছিলেন। উনি সাক্ষী আছেন। কী নন্দাজি, আপনি বলুন!’’ কিরণবাবু প্রকাশ্যেই শিবপালের প্রতিবাদ করে বলেন, ‘‘গিয়েছিলাম। কিন্তু এমন কথা অখিলেশ বলেনি।’’ শিবপাল বলেন, ‘‘সে কী! মিথ্যে বলবেন না!’’ কিরণময়বাবু পাল্টা বলেন, ‘‘আমি এ রকম কোনও কথা ওঁর মুখ থেকে শুনেছি বলে মনে পড়ছে না!’’ যে প্রসঙ্গে মঙ্গলবার তাঁর মন্তব্য, ‘‘অখিলেশ মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ভাল কাজ করেছেন। শিবপালও দলের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। কিন্তু কাকা যদি আমাকে সাক্ষী রেখে ভাইপোর বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা বলেন, তা হলে তো প্রতিবাদ করতেই হবে!’’
আপাতদৃষ্টিতে তিনি মুলায়মের সঙ্গেই আছেন। আবার ঘনিষ্ঠ মহলে বলছেন, ‘‘অমর সিংহই যত নষ্টের গোড়া। অখিলেশ ঠিকই বলছে!’’ অমর সোমবার তাঁর পুরনো শহর কলকাতায় বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, এই পারিবারিক বিরোধে তিনি নেই। আর মুলায়মের পাশে থেকেও অমরের উল্টো পথে হেঁটে কিরণবাবু বলেন, ‘‘অখিলেশের বিরুদ্ধে দল ভাঙার যড়যন্ত্রের যে অভিযোগ আনা হচ্ছে, তা মনগড়া! ভিত্তিহীন!’’ ঘনিষ্ঠ মহলে তাঁর অভিযোগ, মুলায়মকে অনেকে নিজেদের স্বার্থে ভুল বোঝাচ্ছেন। কিরণবাবুর ইঙ্গিত অমরের দিকেই। তাঁর কথায়, ‘‘অমরকে দলে নেওয়ার পরেই নতুন করে বিবাদ বেধেছে। ওর কাজই ঘরে ঝগড়া বাধানো!’’ অমরের সঙ্গে বিবাদের জেরেই এক সময়ে মুলায়মের সঙ্গ ছাড়েন কিরণবাবু। অমরকে বহিষ্কারের পরে ২০১১ সালে মুলায়মের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়। মুলায়মই তাঁকে রাজ্যসভায় পাঠান। কিরণবাবুর দ্বিতীয় বাড়ি এখন লখনউ! মুলায়মের ঘরের বিবাদ কত দূর গড়াবে? কিরণবাবুর সহাস্য জবাব, ‘‘সবাই জানে, বিরোধ বাড়লে লাভ বিজেপি বা মায়াবতীর। সব পক্ষকে বুঝিয়ে বিরোধে জল ঢালাই এখন আমার কাজ।’’
পাঁচ বছর আগে বাম জমানার পতনের মুখে এক সাধুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সাধু নাকি বলেন, ‘‘আপ বাঙ্গাল ছোড়কে পচ্চিম পে যাওগে।’’ রাজনীতিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবেন বলেও ভবিষ্যদ্বাণী ছিল সেই সাধুর। যাদব বংশের কৈকেয়ী-পর্ব দেখিয়ে দিচ্ছে, গভীর জলের মাছকে চিনতে সাধুরও ভুল হয়নি!