খণ্ডে খণ্ডে লাশ পাচার আগেও দেখেছে মহানগর

নৃশংসতার নিরিখে বিরল ঠিকই। তবে একেবারে বেনজির নয়। ব্যাগভর্তি দেহাংশ গঙ্গায় ফেলতে গিয়ে ভুটভুটির সহযাত্রীদের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছেন সমরেশ সরকার।

Advertisement

শিবাজী দে সরকার

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৫ ০৩:০৪
Share:

নৃশংসতার নিরিখে বিরল ঠিকই। তবে একেবারে বেনজির নয়।

Advertisement

ব্যাগভর্তি দেহাংশ গঙ্গায় ফেলতে গিয়ে ভুটভুটির সহযাত্রীদের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছেন সমরেশ সরকার। জানা গিয়েছে, দুর্গাপুরের ওই ব্যাঙ্ক ম্যানেজার এক মহিলা ও তার শিশুকন্যার টুকরো করা দেহ ব্যাগগুলোয় ভরে নিয়ে এসেছিলেন। ঠিক কী ভাবে ও কোন পরিস্থিতিতে মা-মেয়ে খুন হলেন, তা এখনও পরিষ্কার না-হলেও খবরটি শিহরণ তুলেছে। ঘটনার পৈশাচিকতায় আম-জনতা স্তম্ভিত।

তবে গত পনেরো বছরের পুলিশি খতিয়ানে কলকাতা ও আশপাশে এমন ‘পৈশাচিক’ আরও অন্তত সাতটি হত্যাকাণ্ডের হদিস মিলছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে খুনের পরে দেহ কেটে টুকরো করে ব্যাগ, বস্তা বা ট্রাঙ্কে ভরে পাচারের চেষ্টা হয়। কিছু ক্ষেত্রে কুপিয়ে-খুঁচিয়ে ক্ষতবিক্ষত লাশ ঠেসে ঢোকানো হয়েছে ব্যাগে বা বাক্সে।

Advertisement

সাতটির চারটে কলকাতা পুলিশ এলাকার। সব ক’টায় নিহতকে শনাক্ত করে অভিযুক্তদের ধরা হয়েছে। তিনটি রেল-পুলিশের আওতায়। একটির কিনারা হলেও দু’টিতে নিহতের পরিচয় এখনও অজানা। ওই দু’টিতে উদ্ধার দেহাংশগুলির একটি ছিল মহিলার, অন্যটি পুরুষের। তাদের লাশ কেটে টুকরো টুকরো করে বস্তা ও ব্যাগে পুরে রেলের কামরা ও লাইনের ধারে ফেলে রাখা হয়েছিল।

চেন্নাই মেল রহস্য

২০০০ সালের এপ্রিল। হাওড়ায় পৌঁছানো ডাউন চেন্নাই মেলের কামরায় বেওয়ারিশ বস্তা। খুলে দেখা গেল, ভিতরে এক মহিলার মাথা ও দু’টো কাটা হাত। প্রায় একই সময়ে ওড়িশার বোলাঙ্গির স্টেশনে পাওয়া যায় এক মহিলার ধড়, আর হায়দরাবাদের নামপল্লি স্টেশনে দু’টি পা। সব জোড়া দিয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয়, এ সব একই মহিলার। কিন্তু তিনি কে, পনেরো বছরেও রেল-পুলিশ জানতে পারেনি। তদন্তে ঝাঁপ পড়েছে।

লোকালে কে

শিয়ালদহ স্টেশনে দাঁড়িয়ে ডানকুনি লোকাল। এক কামরায় পড়ে রয়েছে সাদা একটা লাগেজ ব্যাগ, যার কোনও দাবিদার নেই! ২০১২-র ফেব্রুয়ারির সেই রাতে ব্যাগ খুলে পাওয়া যায় এক পুরুষ-শরীরের নিম্নাংশ। নাভি থেকে উরু পর্যন্ত। নুন মাখানো। প্রসঙ্গত, আগের রাতে কল্যাণী স্টেশনে লাইনের ধারে ব্যাগের ভিতরে পাওয়া গিয়েছিল একটি মাথা-সহ খণ্ডবিখণ্ড দেহ। রেল-পুলিশ দুই ব্যাগের দেহাংশ জোড়া দিয়ে দেখে, তা একই লোকের। তবে সাড়ে তিন বছরেও জানা যায়নি, তিনি কে। তদন্ত থমকে রয়েছে।

আধাআধি

পারিবারিক বিতণ্ডার জের গড়াল খুনে। তাতেই শেষ নয়, দেহ কেটে দু’ভাগ করা হল! ২০০৩-এর নভেম্বরে বেলেঘাটাবাসী যুবক মিটন দাসের পরিণতি এমনই। পুলিশের দাবি, মিটনের দুই পরিজন তাঁকে মেরে দেহ দু’টুকরো করেছিল। মাথা থেকে উরু পর্যন্ত অংশ ভরা হয় একটি টিভির বাক্সে। বেলেঘাটা চাউলপট্টি রোডের ধারের খালে ফেলে আসা হয় বাক্সটি। পরে খাল থেকে দেহের বাকি অংশও উদ্ধার হয়।

থলিতে একরত্তি

বয়স মাত্র এক বছর। ফুটফুটে বাচ্চাটিকে গলা টিপে মেরে ধারালো অস্ত্রে সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত করতে খুনিদের হাত কাঁপেনি। বেলেঘাটার সেই ইন্দ্রজিৎ সাহার দেহ শপিং ব্যাগে ভরে উল্টোডাঙা খালের কাছে ফেলে গিয়েছিল দুষ্কৃতীরা। ২০০৮-এর ডিসেম্বরের ওই ঘটনার এক দিন বাদে ডানকুনি টোলপ্লাজার কাছে বস্তাবন্দি অবস্থায় পাওয়া যায় ইন্দ্রজিতের মা বুলা সাহার দেহও। বুলাদেবীর শরীর অবশ্য অবিকৃত ছিল। চার্জশিটে পুলিশ জানায়, পারিবারিক বিবাদে মা-ছেলেকে খুন করেছে দুই আত্মীয়।

লাশ-বাক্স

ছ’মাসের মাথায় আবার আঁতকে উঠল কলকাতা। ২০০৯-এর জুনে নারকেলডাঙা খালের পাশে রেলব্রিজের নীচে পড়ে থাকা টিনের বাক্স খুলে দেখা গেল, এক মহিলার দেহ ঠেসে-ঠুসে ভরা। কুপিয়ে মারা হয়েছে। গোয়েন্দারা জানতে পারেন, মহিলার নাম স্বপ্না চক্রবর্তী, বাড়ি বিধাননগরে। অভিযুক্তেরা ধরা পড়ে।

কোডে কিনারা

প্রায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ২০১১-র ফেব্রুয়ারিতে। নিউ আলিপুরে পরিত্যক্ত টিভির বাক্সের ভিতরে মিলল এক প্রৌঢ়ার শব। ধারালো অস্ত্রে দেহটি এমনই বিকৃত যে, শনাক্তকরণের উপায় ছিল না। পরে বাক্সে লাগানো টিভি নির্মাতা সংস্থার ‘বার কোড’-এর সূত্র ধরে হাওড়া শিবপুরের বাসিন্দা ওই প্রতিবন্ধী মহিলাকে শনাক্ত করে পুলিশ। এক আত্মীয় গ্রেফতার হয়।

ব্যাগে মুন্ডু

গত বছরের মে মাস। আবার শিয়ালদহ স্টেশন। ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের কাছে পড়ে ছিল ট্রলিব্যাগ ও বেডিং। ব্যাগে পাওয়া যায় এক মহিলার মাথা, হাত, পা। বেডিংয়ে, গলা থেকে কোমড় পর্যন্ত দেহাংশ। ট্রলিব্যাগের সূত্রে জানা যায়, মহিলার নাম জয়ন্তী দেব, বাড়ি লেকটাউনে। তাঁর স্বামী-সহ তিন জন ধরা পড়ে।

মানুষ এত নৃশংস হয় কী ভাবে?

মনস্তত্ত্ববিদদের একাংশের দাবি, অনেক ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার তাগিদে এ ভাবে কেটে-কুটে লাশ পাচারের চেষ্টা করে খুনিরা। মনস্তত্ত্ববিদ অনিরুদ্ধ দেবের কথায়, ‘‘একটা উদ্দেশ্য, নিহতের পরিচয় গোপন রাখা। দ্বিতীয়ত, প্রমাণ লোপাট। টুকরো দেহ সহজেই ব্যাগে-বস্তায় ভরে নিয়ে যাওয়া যায়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন