নব্বইয়ে মোরগঝুঁটি, জন্মদিনে টিনটিনময় শহর

ব্রাসেলসে নিজের স্টুডিয়োয় বসে সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি টিনটিনের স্রষ্টা অ্যার্জে। এবিপি গোষ্ঠীর তৎকালীন ‘দ্য সানডে’ পত্রিকার জন্য সাক্ষাৎকারে শুধু আভাস দিয়েছিলেন, তিনি কখনও ভারতে এলে বিষয়টি দেখা যেতে পারে।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:৫৫
Share:

সোশ্যাল মিডিয়ায় অচ্যুত দাসের পোস্ট।

চার দশক আগেই এক বার কলকাতায় আসার কথা উঠেছিল ‘তার’।

Advertisement

ব্রাসেলসে নিজের স্টুডিয়োয় বসে সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি টিনটিনের স্রষ্টা অ্যার্জে। এবিপি গোষ্ঠীর তৎকালীন ‘দ্য সানডে’ পত্রিকার জন্য সাক্ষাৎকারে শুধু আভাস দিয়েছিলেন, তিনি কখনও ভারতে এলে বিষয়টি দেখা যেতে পারে। পরে আনন্দমেলা-তেও সেই সাক্ষাৎকার নেওয়ার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

শেষমেশ অবশ্য কলকাতায় আসা হয়নি টিনটিনের। ‘তিব্বতে টিনটিন’-এ এক বারটি দিল্লি ছুঁয়ে যাওয়া ছাড়া ভারতটাই তার অদেখা থেকে গিয়েছে। ২০১৯-এর এই বৃহস্পতিবার কলকাতার অনেকে তবু টিনটিনময় হয়ে থাকলেন। সোশ্যাল মিডিয়ার জমানায় সচরাচর কারও জন্মদিন লুকিয়ে রাখা মুশকিল। আর টিনটিনের জন্মদিন হলে তো ব্যাপারই আলাদা!

Advertisement

একটা সময়ে নতুন আনন্দমেলা বেরোলেই বাংলায় টিনটিন পড়ার জন্য ঘরে ঘরে ভাইবোনে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। এ দেশে বাংলাতেই প্রথম রূপান্তর টিনটিনের। বাড়িতে ধবধবে লোমওয়ালা কুকুর থাকলেই তার নাম হত কুট্টুস! ক্লাসের খাড়া খাড়া চুলওয়ালা ছেলেটা ‘টিনটিন’ কিংবা সারা ক্ষণ বইমুখো পড়ুয়াটিকে ‘প্রফেসর ক্যালকুলাস’ বলে ডাকা ছিল দস্তুর। ছোটদের ঝগড়ায় আনন্দমেলা-র পাতায় হ্যাডকের আদলে ‘বিদ্ঘুটে বকচ্ছপ’, ‘উড়ুক্কু মাছ’ গোছের গালাগালিরও তখন খুব কদর! সেই প্রজন্মের খুদেরা এখন অনেকেই মধ্যচল্লিশ বা ৫০ ছুঁইছুঁই। এখনও মাঝরাতে আধবুড়ো বন্ধুদের হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপে একটু তুরীয় মেজাজে কেউ উদ্ভট ইংরেজি-বাংলায় গালমন্দ করলে তাঁর নাম হয় ক্যাপ্টেন হ্যাডক। বাঙালির সেই টিনটিন-আবেগের ধারাটিই এ বার খানিক ভিন্ন মাত্রা পাচ্ছে।

বেলজিয়ান দৈনিক ‘ল্য পেতি ভ্যানতিয়েম’-এ প্রথম টিনটিন-কাহিনি প্রকাশ এ দিন ৯০ বছর পার করল। শুধু সে জন্যও নয়। কয়েক দিন আগেই টিনটিনকে বাংলায় ভাষান্তরিত করার রূপকার নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর প্রয়াণেও মোরগঝুঁটি সাংবাদিকের স্মৃতি উজ্জ্বল। টিনটিনের আনন্দমেলা-যুগের পাঠক, অধুনা চিকিৎসক-লেখক ইন্দ্রনীল সান্যাল স্বভাবতই বাড়তি আবেগে ভাসছেন। অ্যার্জে তখন নিয়মিত কলকাতা থেকে ছোটদের চিঠি পেতেন। আনন্দমেলা-য় টিনটিনের সঙ্গে আলাপের পরে ইন্দ্রনীলের মতো অনেকেই বুক ঠুকে ইংরেজিতে চিঠি লিখে এরোগ্রামে অ্যার্জে সাহেবের জবাব পেয়েছিলেন।

নীরেনবাবুর কন্যা, এখন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের অধ্যক্ষ শিউলি সরকার বাবার পিছনে দাঁড়িয়ে সেই আনন্দমেলার অনুবাদ চাক্ষুষ করার অন্যতম সাক্ষী। তিনি বলছিলেন, ‘‘বাবা কিন্তু মূল ফরাসির মিলু বা ইংরেজির স্নোয়ির সঙ্গে মিলিয়ে টিনটিনের কুকুরের নাম রাখতে চাননি। হাড়-রসিক সেই কুকুরের নামে একটা কামড়ের অনুষঙ্গ যোগ করতেই তা হল, কুট্টুস!’’ বাঙালির আপনজন এই টিনটিনের কাহিনির সূক্ষ্ম রসবোধ এবং রহস্য-রোমাঞ্চের টান কতটা অটুট এখন?

একনিষ্ঠ টিনটিন-প্রেমিক সত্যজিৎ রায়ের পুত্র সন্দীপ রায়ের টিনটিন পড়তে শেখাও বাবার হাত ধরেই। তিনি বলছিলেন, ‘‘আমার মতো আমার ছেলেও কিন্তু তার কৈশোরে টিনটিন-অ্যাসটেরিক্সের গল্পে মজেছিল।’’ ইউরোপীয় ঘরানার এ সব কমিকসের গল্প-ছবির মেজাজটাই আলাদা বলে মনে করেন সন্দীপ! টিনটিনের গল্পে প্লট অনুযায়ী দিনে-রাতে পাতার রং পাল্টে যায়। ধারাবাহিক প্রকাশের শর্ত মেনে প্রতি পাতার শেষে মিশে থাকে চমক। আর কাহিনির মোচড়ে মিশেই ভুসভুসিয়ে ওঠে মজা! এর পাশে আমেরিকান ঘরানার সুপারম্যান গোত্রের কমিকস অনেকটাই গতি-নির্ভর।

এ যুগে মানুষের পড়ার ঝোঁক কমা নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। তবে আনন্দ পাবলিশার্স-এ বাংলা টিনটিনের কাটতি বছরভর। মূল টিনটিনের প্রকাশকেরা আনন্দ-র আধিকারিক সুবীর মিত্রের কাছেও বাংলা টিনটিনের ছাপার মানের ভূয়সী তারিফ করে গিয়েছেন। ইউরোপিয়ান কমিশনের টুইটে এ দিন টিনটিনের সাংস্কৃতিক অবদানের কথা উঠে এসেছে। কলকাতার বাঙালি কার্টুন টিনটিনকে ধুতি-পাঞ্জাবি পরিয়েছে। শহরের রেস্তরাঁয় নানা টিনটিন-স্মারক, থিম-কেক ছড়িয়ে পালন হচ্ছে তার জন্মদিন।

সোশ্যাল মিডিয়ায় বাঙালির তর্কে শ্বেতাঙ্গ টিনটিনের জাত্যভিমান নিয়ে চর্চাও কান পাতলে শোনা যাবে অবশ্য। চার দশক আগের সেই সাক্ষাৎকারে অ্যার্জেও বলেছিলেন, ‘কঙ্গো থেকে সোভিয়েত দেশে টিনটিন-কাহিনির জন্য সব ধরনের লোক টিনটিনের বিরুদ্ধে সব ধরনের অভিযোগ এনেছে। কিন্তু আমার কোনও ন্যায়-অন্যায় প্রমাণের দায় ছিল না। সরস ভঙ্গিতে দুনিয়াটা ঠিক যেমন, তেমনই দেখতে চেয়েছি।’

তার ৯০ বছরের জন্মদিনেও এই রসিক মনই জিতে যাচ্ছে। টিনটিনকে নিয়ে এলোমেলো কথা এখনও বাঙালির রাত্রিদিন ভরে রেখেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন