Juvenile

নাবালকদের সুরক্ষা দিতে আইনি পথ এড়ানোর বার্তা

নাবালক-নাবালিকা একে অপরকে ভালবাসলেও সেই ‘অপরাধ’-এর সাজা দিতে পুলিশে অভিযোগ জানান মেয়েটির মা-বাবা। ফলে পকসো ধারা যুক্ত হয়ে নাবালকটির ঠাঁই হয় হোমে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০২৩ ০৬:৪৪
Share:

ছোট-বড় অপরাধ ঘটিয়ে ফেলা কিশোর-কিশোরীরা জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্টের আওতায় এসে যাচ্ছে। প্রতীকী ছবি।

কথা বলায় সমস্যা থাকায় প্রায়ই কিশোরটির পিছনে লাগত অন্যেরা। রাগ হলেও কিছু বলতে পারত না সে। এক দিন রাগের বশে পাথর ছুড়ে মারলে মাথায় লেগে মৃত্যু ঘটে আর এক কিশোরের। নির্যাতিত কিশোরের পরিচয় হয়ে ওঠে ‘অভিযুক্ত’!

Advertisement

নাবালক-নাবালিকা একে অপরকে ভালবাসলেও সেই ‘অপরাধ’-এর সাজা দিতে পুলিশে অভিযোগ জানান মেয়েটির মা-বাবা। ফলে পকসো ধারা যুক্ত হয়ে নাবালকটির ঠাঁই হয় হোমে। এক লহমায় বদলে যায় ‘অভিযুক্ত’ নাবালকের জীবন।

এ ভাবেই অকস্মাৎ ছোট-বড় অপরাধ ঘটিয়ে ফেলা কিশোর-কিশোরীরা জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্টের আওতায় এসে যাচ্ছে। তার পর থেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পথ প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাদের সামনে। আইনি জটিলতায় আবদ্ধ হয়ে কার্যত ‘শেষ’ হয়ে যাচ্ছে তাদের জীবন। তাই প্রথাগত আইনি পদ্ধতি এড়িয়ে, বিকল্প পথে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো কী ভাবে সম্ভব— তা নিয়েই রবিবার কথা হল শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন এবং ইউনিসেফ আয়োজিত এক আলোচনাসভায়।

Advertisement

জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট ২০১৫-এর ৩ নম্বর ধারায় এই ‘ডাইভারশন’ অর্থাৎ অপসারণ পদ্ধতির উল্লেখ থাকলেও তা এ দেশে তেমন প্রচলিত নয়। অথচ নাবালক-সুরক্ষায় এটিই হয়ে উঠত পারে অন্যতম হাতিয়ার। সাধারণত সামান্যতম অপরাধ করেও অভিযুক্ত নাবালক-নাবালিকাকে কোর্টের সামনে দাঁড়াতে হয়, ঠাঁই হয় হোমে। এর ফল হয় মারাত্মক। তাই কী ভাবে বিচারব্যবস্থার বাইরে তাকে রাখা যেতে পারে, অথবা অতি দ্রুত সেই পথ থেকে সরিয়ে এনে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো যায়— তা নিয়ে আলোচনা হয় এ দিন। ছিলেন রাজ্য ইউনিসেফের প্রধান মহম্মদ মহিউদ্দিন, কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অনন্যা বন্দোপাধ্যায়, শিশুসুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুদেষ্ণা রায়, মন্ত্রী শশী পাঁজা-সহ অনেকে।

হাই কোর্টের বিচারপতি জানান, অস্ট্রেলিয়ার মতো ‘অপসারণ’ পদ্ধতির অনুসরণ করতে পারে এ রাজ্যও। তিনি বলেন, ‘‘প্রতিটি নাবালক বা নাবালিকা, তা সে অভিযুক্ত বা নির্যাতিত যা-ই হোক, ন্যায়বিচার পাওয়ার যোগ্য। এক জন প্রাপ্তবয়স্কের থেকে কিশোর অভিযুক্তকে আলাদা চোখে দেখুন। কারণ ওদের সহানুভূতি নয়, সহমর্মিতা প্রয়োজন। ওরা কেন, কোন পরিস্থিতিতে অপরাধ করেছে— সেটা আমাদের বুঝতে হবে।’’ আলোচনাসভায় উপস্থিত, জেলার জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে এই ধরনের মামলাগুলি আবেগ দিয়ে দেখার আবেদন করেন তিনি।

সুদেষ্ণা বলেন, ‘‘অনেক সময়েই দেখা গিয়েছে, কোনও অভিযুক্ত নাবালক-নাবালিকাকে হয়তো নামমাত্র অপরাধে হোমে পাঠানো হয়েছে, যা সহজেই এড়ানো যেত। তাই আইনের এই ধারার ব্যবহারিক প্রয়োগের প্রয়োজন রয়েছে।’’

অপ্রচলিত এই পদ্ধতির সঠিক রূপায়ণে ভূমিকা নিতে পারেন পুলিশ, বিচারক, মনোরোগ চিকিৎসকেরাও। ইউনিসেফের শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ পারমিতা নিয়োগীর ব্যাখ্যা,পুলিশের কাছে অভিযোগ এলে তা খতিয়ে দেখে কিশোর-কিশোরীকে সেখান থেকেই বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারে তারা। অথবা অন্য ভাবে শাস্তি দিয়ে তাকে নিজের ভুল বোঝার এবং সংশোধনের সুযোগ করে দিতে পারে। পরবর্তী ধাপে একই কাজ করতে পারেন জুভেনাইল জাস্টিস ম্যাজিস্ট্রেটরাও। এ ক্ষেত্রে অতীতে অভিযুক্তের কোনও অপরাধের রেকর্ড আছে কি না, বা অপরাধেরভয়াবহতা কতটা— তা দেখে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো যেতে পারে। ‘অতি জঘন্য’ অপরাধ ছাড়া সব ক্ষেত্রেই চাইলে অভিযুক্ত নাবালকদের আড়াল করার সুযোগ থাকছে। তৃতীয় ধাপে তাকে হোমে পাঠানোহলেও ম্যাজিস্ট্রেট অতি দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি করে তাকে বাড়ি পাঠাতে পারেন।

একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাত ধরে রাজ্য সরকার ও ইউনিসেফ জলপাইগুড়ি, মুর্শিদাবাদ ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এ সংক্রান্ত ‘পাইলট প্রজেক্ট’ চালু করলেও আরও অনেকটা পথ চলা বাকি। ইউনিসেফ প্রধান বলছেন, ‘‘গত তিন বছরে দেখা গিয়েছে, অপসারণের সংখ্যাটি যথেষ্ট নয়। এই সব কিশোর-কিশোরীদের সামাজিক-মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।’’

এর পরেও স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে গিয়ে সামাজিক, পারিবারিক দিক থেকে বাধা, তির্যক মন্তব্য, অসহিষ্ণুতা, অগ্রহণযোগ্যতার মুখে পড়তে পারে কোনও অভিযুক্ত নাবালক বা নাবালিকা। যা তার জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। তেমন পরিস্থিতি এড়াতে অভিযুক্ত ও তারপরিবারের কাউন্সেলিং প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন রাজ্যের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা। তাঁর কথায়, ‘‘দেশের মধ্যে এ রাজ্যেই প্রথম এই পদক্ষেপ করা হচ্ছে। কোনও নাবালককে কোর্টে দাঁড়াতে হলে তার মানসিক সমস্যা হতে পারে। ফলে ভবিষ্যতে ফের অপরাধ করার আশঙ্কা থেকে যায়। তাই পুলিশ, জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের সদস্য, সমাজকর্মী— সকলকেই আরও সংবেদনশীল হতে হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন