দারিদ্রে আরও ভয়াবহ সেরিব্রাল পলসি

সেই শিশুই যদি কোনও দরিদ্র, নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্মায়, তা হলে পরিস্থিতির সার্বিক অভিঘাতে শিশুর স্বাস্থ্য বা শারীরিক অবস্থার কতটা অবনতি হতে পারে, তা প্রকট হয়েছে কলকাতার পাঁচটি ওয়ার্ডে চলা একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায়।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৭ ০১:১৬
Share:

সালমা বিবি ও মেয়ে নাজমুন্নিসা। রেশমী বিবি ও ছেলে আহদ।

আজীবনের অসুস্থতাকে সঙ্গী করে জন্মানো শিশুকে নিয়ে উচ্চবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্ত, তথাকথিত সুশিক্ষিত পরিবারেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা, আক্ষেপ, দুশ্চিন্তা, পারস্পরিক দোষারোপের ঝড় বয়ে যায়। ওই শিশুকে সহযোগী চিকিৎসা দেওয়া, তার যত্ন ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার মতো আর্থিক সঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও পদে পদে সমস্যার মুখে পড়তে হয় পরিবারকে। সেই শিশুই যদি কোনও দরিদ্র, নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্মায়, তা হলে পরিস্থিতির সার্বিক অভিঘাতে শিশুর স্বাস্থ্য বা শারীরিক অবস্থার কতটা অবনতি হতে পারে, তা প্রকট হয়েছে কলকাতার পাঁচটি ওয়ার্ডে চলা একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষায়।

Advertisement

চলতি বছর এপ্রিল মাস থেকে কলকাতার ৫৬, ৫৭, ৫৮, ৬৫ এবং ৬৬ নম্বর ওয়ার্ডে ট্যাংরা, তপসিয়া, তিলজলা, বিবি বাগান, মতিঝিল, পিলখানার মতো কিছু এলাকার বস্তি অঞ্চলে বাড়ি-বাড়ি ঘুরে সেরিব্রাল পলসি আক্রান্ত শিশুদের চিহ্নিত করা শুরু করেছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এই প্রকল্পে অর্থ সাহায্য করছে অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ড-এর সেরিব্রাল পলসি রিহ্যাবিলিটেশন রিসার্চ সেন্টার। এর সহযোগী কলকাতা চাইল্ডলাইন এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সেরিব্রাল পলসি। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, অতি দরিদ্র এই পরিবারগুলিতে অসুস্থ শিশুরা এতটাই অবহেলিত যে, তারা ন্যূনতম যত্ন তো দূর অস্ত্‌, ভালভাবে দু’বেলা খেতে পর্যন্ত পাচ্ছে না। ফলে তারা চূড়ান্ত অপুষ্টির শিকার হচ্ছে এবং ভগ্নস্বাস্থ্যের জন্য তাদের মৃত্যু ত্বরান্বিত হচ্ছে! প্রকল্পের প্রোগ্রাম অফিসার দিলীপ বসু এবং সুপারভাইজার সিরিন পারভিন জানান, এই আর্থসামাজিক স্তরে থাকা পরিবারগুলিতে শিশুর আসলে কী রোগ হয়েছে, সেটাই নির্ণয় হয় না। তার আগেই হয়তো শিশু অপুষ্টিতে, অনাদরে মারা যায়।

নভেম্বর পর্যন্ত কলকাতার ওই পাঁচটি ওয়ার্ডের বস্তি এলাকা থেকে তারা ২০০ জন সেরিব্রাল পলসি আক্রান্ত শিশুকে চিহ্নিত করেছে। এদের মধ্যে ২০ জনকে এই প্রকল্পের আওতায় হেলথ থেরাপি, প্লে থেরাপি, পুষ্টিকর খাবার দেওয়া এবং তাদের অভিভাবকদের প্রশিক্ষণ, কাউন্সিলেংয়ের আওতায় আনা হয়েছে। ধাপে ধাপে ২০০ জনকেই এই পরিষেবার আওতায় আনা হবে। ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের সময়সীমা ধার্য হয়েছে। প্রকল্পের রিপোর্ট জমা দেওয়া হবে রাজ্য সরকারকে।

Advertisement

সমীক্ষকেরাই জানাচ্ছেন, ওই ২০টি শিশুর মধ্যে ধাপা, ধোবিয়াতলা, মতিঝিল, বিবিবাগানে এমন ৮টি শিশুকে পাওয়া গিয়েছে, যাদের শরিরীক অপুষ্টি মারাত্মক ধরনের। কারণ, নিজেদের পরিবারেই তারা ব্রাত্য। তাদের বোঝা মনে করে ঘরের কোণে স্রেফ ফেলে রাখা হয়। এই গবেষণা প্রকল্পের অন্যতম প্রধান মণিদীপা ঘোষের কথায়, ‘‘এই সব পরিবারের বাবা-মায়েরা প্রতিদিনের খাবার জোগাড় করতেই উদয়াস্ত খাটছেন। প্রায় সকলেরই তিনটে-চারটে করে বাচ্চা। চূড়ান্ত অভাবের সংসারে কাজ সামলে আলাদা করে অসুস্থ বাচ্চার দিকে নজর দেওয়ার মতো সময় এবং অর্থ, কোনওটাই নেই। অনেকে সরাসরি জানিয়েছেন, তাঁরা চান অসুস্থ শিশুটি যেন তাড়াতাড়ি মারা যায়। তার উপরে সেই শিশু যদি মেয়ে হয়, তা হলে তার কপালে আরও দুঃখ থাকে। সব মিলিয়ে ওই শিশুরা চূড়ান্ত অবহেলিত।’’

৫৮ নম্বর ওয়ার্ডের ধোবিওয়াতলা বস্তির এক চিলতে গলির ভিতরে একটি ছোট্ট ঘরে থাকেন মহম্মদ জাকারিয়া ও সালমা বিবি। জাকারিয়া ভ্যান চালান। তাঁদের পরপর দুই মেয়ে। বড়টি দেড় বছরের নাজমুন্নিসা। সেরিব্রাল পলসি আক্রান্ত। চোখে ভাল করে দেখে না। বসতেও পারে না। সালমা জানালেন, নাজমুন্নিসাকে কী ভাবে ধরে কী করে খাওয়াতে হবে, সেটাই তাঁর জানা ছিল না। ফলে না খেয়ে অপুষ্টিতে শীর্ণ হয়ে গিয়েছিল অসুস্থ মেয়ে। সমীক্ষক দল এসে তাঁকে সেই পদ্ধতি শিখিয়েছে। পাশের গলির প্লাস্টিক কারখানার শ্রমিক মহম্মদ কবীর আর রেশমী বিবির দেড় বছরের ছেলে আহদও সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত। খাবারের অভাবে সে-ও অপুষ্টিতে ভুগছিল। মা-বাবার কাউন্সেলিং করেছেন সমীক্ষকেরা। আহাদের চোখের দৃষ্টি ঠিক করতে প্লে থেরাপি চলছে।

৫৬ নম্বর ওয়ার্ডে মতিঝিল এলাকায় দিনমজুর মহম্মদ তবরুখ ও রুখমানা বিবির দেড় বছরের মেয়ে তবসুম। সেরিব্রাল পলসি আক্রান্ত মেয়ে মরে যাবে ধরে নিয়ে তাকে নিতান্ত অবহেলায় ফেলে রেখেছিলেন বলে স্বীকার করেন অভিভাবকেরাই। তাঁদের কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি শিশুটিকে এখন সস্তা অথচ পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো হচ্ছে। বিশেষ স্বাস্থ্য থেরাপিও চলছে।

কিন্তু সমীক্ষকদের মতে, খোদ কলকাতাতেই যদি এই অবস্থা হয়, তা হলে মফস্‌সল এবং গ্রামাঞ্চলে নিম্নবিত্ত বা দারিদ্রসীমার নীচে থাকা পরিবারের সেরিব্রাল পলসি আক্রান্ত শিশুদের দুরবস্থা সহজেই অনুমেয়। জিজা ঘোষের মতো সেরিব্রাল পলসি আক্রান্তদের অধিকার আন্দোলনের কর্মীদের বক্তব্য, সরকারি হাসপাতালে জন্মের পরেই সেরিব্রাল পলসি স্ক্রিনিংয়ের কোনও ব্যবস্থা নেই। একমাত্র এনআরএস ছাড়া আর কোনও হাসপাতালে সামান্য অক্যুপেশনাল থেরাপিরও ব্যবস্থা নেই। আশা কর্মী বা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের দিয়েও এই রোগে আক্রান্ত শিশুদের কোনও পরিষেবা দেওয়া হয় না। ১৯৯৯ সালে ন্যাশনাল ট্রাস্ট অ্যাক্ট-এ সেরিব্রাল পলসি, অটিজম, মেন্টাল রিটার্ডেশন ও মাল্টিপল ডিসেবিলিটিতে আক্রান্তদের জন্য একগুচ্ছ সুযোগ-সুবিধার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তার কিছুই কার্যকর হয়নি। এমনকী এমন হোমও মেলে না যেখানে এই শিশুদের ঠাঁই দেওয়া যায়। গরিবেরা যাবেন কোথায়?’’ সুদীর্ঘ সময় ধরে সেরিব্রাল পলসি আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করছেন সুধা কল। বিগত ১০ বছরে অবস্থার অনেক উন্নতি হলেও সরকারি স্তরে পরিষেবার ঘাটতি মেনেছেন তিনিও। বলেছেন, ‘‘যতটুকু সুবিধা বা অধিকার সরকারি আইনে রয়েছে, তা মানুষকে জানানোও হচ্ছে না। গরিব মানুষেরা এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন