অদৃশ্য হানাদার ঠেকাতে চলছে যুদ্ধ। যাঁরা প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে লড়ছেন, তাঁদের আত্মত্যাগ যেন যথাযথ সম্মান পায়। এই থাক প্রতিজ্ঞা।

আমরাও যে প্রথম সারির যোদ্ধা, মানেন ক’জন

অদৃশ্য হানাদার ঠেকাতে চলছে যুদ্ধ। যাঁরা প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে লড়ছেন, তাঁদের আত্মত্যাগ যেন যথাযথ সম্মান পায়। এই থাক প্রতিজ্ঞা।

Advertisement

সুমিতা নন্দী

শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০২১ ০৬:৫৮
Share:

প্রতীকী চিত্র।

গলা-নাক থেকে নমুনা সংগ্রহ করি আমরা। সেটাই সংক্রমণ নির্ণয়ের প্রথম ধাপ। সেই নমুনা সংগ্রহের কাজ ঠিক মতো না হলে কোনও ভাবেই যথাযথ রিপোর্ট আসবে না। সেই অর্থে আমরাও যে প্রথম সারির যোদ্ধা, মানেন ক’জন? কোভিড-যোদ্ধা হিসেবে ডাক্তার, নার্সের সঙ্গেই উচ্চারিত হয় নমুনা পরীক্ষক, স্ক্যাভেঞ্জার, অ্যাম্বুল্যান্স চালকদের নাম। আর আমরা ব্রাত্য থেকে যাই। আমাদের কথা আলাদা করে ভাবাই হয় না। এই দুঃখ থাকলেও পেশা বদলের কথা ভাবিনি।

Advertisement

কারণ, চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করাই আমার কাছে জীবনের আকর্ষণ। এক সময়ে অফিসে অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ করতাম। কিন্তু সেই একঘেয়ে কাজে সন্তুষ্ট ছিলাম না। ছেলের জন্মের পরে কিছু দিনের জন্য কাজে বিরতি নিয়েছিলাম। পরে প্রাইভেটে নার্সিং পাশ করে এই পেশায় আসি। তা-ও হয়ে গেল প্রায় বছর পনেরো। বিভিন্ন সংস্থা ঘুরে গত তিন বছর ধরে সুরক্ষা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের এলগিন রোড কেন্দ্রে আছি।

বরাবর অফিসে বসেই রক্ত বা নমুনা সংগ্রহের কাজ করতাম। অতিমারি পরিস্থিতি শুরু হতে মাঝেমধ্যেই আমার উপরে দায়িত্ব পড়েছে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করার। আমার কেন্দ্রে এই পেশায় আমিই একমাত্র মেয়ে। অফিসের এই দায়িত্ব সামলাই আমি এবং আরও এক সহকর্মী। বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহের কাজ করেন অন্য এক জন। তবে কাজের চাপ বাড়লে তখন আমাকেও বাইরে যেতে হয়।

Advertisement

বাড়ি বাড়ি নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে অদ্ভুত সব পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। গত বছর সংক্রমণের প্রথম পর্বে দু’জনের নমুনা সংগ্রহ করতে একটি বাড়িতে গিয়েছিলাম। অনেক ক্ষণ কলিং বেল বাজানোর পরেও কেউ দরজা খুলছিলেন না। ফোন বেজে যাচ্ছে। প্রায় ফিরে আসছি, এমন সময়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন বিধ্বস্ত চেহারার এক যুবক। বুঝলাম, ইনিই সম্ভাব্য সংক্রমিত। কিন্তু বাড়িতে আর কেউ নেই? আপনি দরজা খুলতে উঠলেন? যুবকের উত্তর, ‘‘মা হাসপাতালে ভর্তি। বাবা বাড়িতে, কিন্তু খুব অসুস্থ। রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি। রিপোর্ট এলে হাসপাতালে ভর্তি করতেই হবে।’’ এই কাজে আমার সেই প্রথম অভিজ্ঞতা হতবাক করে দিয়েছিল আমাকে। আরও এক জনের কথা মনে পড়ছে। ডায়াবিটিসের সেই রোগীর নিয়মিত ডায়ালিসিস চলে। সঙ্গে অক্সিজেন চলছিল। আমাকে দেখে বৃদ্ধার চোখে-মুখে প্রশান্তির হাসি। যেন আমি আসা মানেই সব কিছু তাঁর ঠিক হয়ে যাবে। ওই শারীরিক অবস্থায় অনেক কষ্টে নমুনা নিয়েছিলাম। সেটা ওই মাসিমা বুঝতে পেরেছিলেন। চলে আসার আগে হাত দুটো ধরে বলেছিলেন, ‘‘ঠিক করে নিয়েছ তো মা? প্রার্থনা করো, আমি যেন ভাল হয়ে যাই।’’ জানি না, আজ তিনি কেমন আছেন। পিছন ফিরে যে আর দেখা হয় না।

তবে চলতে চলতে যা দেখি, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে রাখছি। নিজের জন্য, পরিবারের জন্য। এখনও পর্যন্ত সংক্রমণ থেকে নিজেকে আর পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছি সেই কারণেই। এটা বড় প্রাপ্তি।

যাদবপুরের পোদ্দারনগরে আমার বাড়ি। স্বামী, ১৭ বছরের ছেলে আর ৮৫ বছরের শাশুড়িকে নিয়ে সংসার। স্বামী শ্রমিক-ঠিকাদার। সরকারি কড়াকড়ির সময়ে তাঁর কাজ বন্ধ থাকে। তখন ভরসা আমার রোজগারটুকুই। এই বয়সেও শাশুড়ির সাহচর্য অস্বীকার করা মস্ত ভুল হবে। আমাকে ক্লান্ত দেখলে উনি এগিয়ে আসেন পাশে। এঁদের কথা ভেবেই, হেড-ক্যাপ, দুটো মাস্ক আর ফেসশিল্ড কখনও খুলে রাখি না।

জানি না, এই যুদ্ধ কত দিন চলবে। নিয়মে কোনও শিথিলতা আনলেই বিপদ। কে সি নাগের সেই অঙ্কের কথা মনে আছে? চপচপে তেল মাখানো বাঁশ বেয়ে বাঁদর উঠছে ঠিকই, দ্রুত নেমেও যাচ্ছে। ঠিক সে ভাবেই সামান্য অসচেতন হলেই কিন্তু নতুন ঢেউ আছড়ে পড়বে। তখন জীবনের অঙ্কে ভুলের বড় খেসারত দিতে হবে।

(লেখক একজন কোভিড নমুনা সংগ্রাহক)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement