Fire in Anandapur

গ্যাস সিলিন্ডার ফাটার আওয়াজে হুঁশ হল, পুড়ছে আমার ঘর

কিছু না ভেবেই এর পরে আমিও ঘরে থাকা বালতি ভর্তি জল নিয়ে আগুন নেভাতে ছুটলাম। আমার বৌমাও তখন বেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কয়েক জন আমাকে ফিরিয়ে দিল।

Advertisement

মনিকা দাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৭:৩৮
Share:

(বাঁ দিকে) বস্তিতে আগুন লেগে ধোঁয়ায় ঢেকেছে এলাকা। মনিকা দাস। (ডান দিকে) —নিজস্ব চিত্র।

সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনের মতো রান্নার তোড়জোড় করছিলাম। সবে আনাজগুলো নিয়ে কাটতে বসেছি। বেলা তখন পৌনে এগারোটা বেজে গিয়েছে। হঠাৎ শুনলাম, চেঁচামেচি হচ্ছে। প্রথমে গুরুত্ব দিইনি। ভাবলাম, বস্তিতে তো মাঝেমধ্যে ঝামেলা-ঝগড়া হয়, তেমনই কিছু হয়তো। কিছু ক্ষণ পরে থেমে যাবে। কিন্তু চিৎকার বাড়তে থাকায় বেরিয়ে এসেছিলাম। এসে দেখি, ভয়ঙ্কর অবস্থা। দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। কেউ কান্নাকাটি করছেন, কেউ বালতি ভর্তি জল নিয়ে ছোটাছুটি করছেন। কোন দিকে যাব, কিছু বুঝেই উঠতে পারছিলাম না। জীবনে এমন দেখিনি। পা দুটো যেন শক্ত হয়ে গিয়েছিল। কাছেই কোথাও গ্যাস সিলিন্ডার ফাটার আওয়াজে হুঁশ হল। দেখি, পুড়ছে আমার ঘরও!

Advertisement

কিছু না ভেবেই এর পরে আমিও ঘরে থাকা বালতি ভর্তি জল নিয়ে আগুন নেভাতে ছুটলাম।
আমার বৌমাও তখন বেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কয়েক জন আমাকে ফিরিয়ে দিল। চিৎকার করে ওরা বলল, ‘‘আমরা আগুন নেভাচ্ছি। তুমি গিয়ে ঘরের জিনিসপত্র বার করো।’’ আশপাশের সকলকেও এই কথা বলতে বলে দিল। তখন সবাই এ দিক-ও দিক দৌড়াদৌড়ি করছে। শেষ সম্বল যে যতটা পারে, ততটুকু বাঁচানোর চেষ্টা আর কী! কেউ পোষ্যদের বার করে আনছে, কেউ হাতের সামনে চাল-ডালের বস্তা যা পাচ্ছে, রাস্তার উল্টো দিকে এনে রাখছে।

আমিও কোনও মতে ঘরে ঢুকে সামনে থাকা কয়েকটি জামাকাপড় বার করে আনতে
পেরেছিলাম। একা মানুষ, একসঙ্গে কতটা আর বার করব? জিনিস রেখে দ্বিতীয় বার যেতে গিয়ে দেখি, আগুনের আঁচ ঘরের ভিতরে এসে গিয়েছে। কালো ধোঁয়ার ঢেকে গিয়েছে গোটা ঘর। তত ক্ষণে একের পর এক দমকলের গাড়ি আমাদের শ্রমিকপল্লির এই বস্তিতে ঢুকছে। আমি যেতে চাইলেও কেউ আর আগুনের দিকে যেতে দেয়নি। রাস্তার অন্য দিকে দাঁড়িয়ে সব কিছু পুড়তে দেখা ছাড়া উপায় ছিল না।

Advertisement

যে ঘর আজ চোখের সামনে পুড়ে গেল, টালির চালার সেই ঘরে আমরা স্বামী-স্ত্রী, বৌমাকে নিয়ে থাকতাম। ছেলে থাকলেও ও আমাদের দেখে না অনেক দিন। অন্যত্র সংসার পেতেছে। আমার স্বামী মাঝেমধ্যে দিনমজুরের কাজ করে। আয় বলতে ওইটুকুই। সেই আয় আর আত্মীয়দের সাহায্যে কোনও মতে আমাদের সংসার চলে। সকালে যখন আগুন লেগেছিল, স্বামী কাজে বেরিয়েছিল। আগুন লেগেছে দেখে ফোন করেছিলাম। দৌড়ে চলে এসেছিল। কিন্তু লাভ হয়নি। আগুনের শিখা তখন কয়েক তলা সমান উঁচুতে উঠে গিয়েছে। চার দিক ধোঁয়ায় ঢাকা। ঘর ভর্তি জিনিস সব দাউদাউ করে জ্বলছে।

এক সকালের আগুনে যে এ ভাবে সব শেষ হয়ে যাবে, দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। যা দু’-এক টাকা জমানো ছিল, সব শেষ হয়ে গেল। কিছুই আর অবশিষ্ট থাকল না। সকলের মতো আমরাও রাস্তায় গিয়ে পড়লাম। স্বামীর গাড়ির ঋণ মেটাবে বলে আমাদের পাড়ার মিনতি কিছু দিন আগেই অন্য জায়গা থেকে ঋণ করে টাকা নিয়ে ঘরে রেখেছিল। ওরও সব জ্বলে গিয়েছে। এমনও পরিবার এখানে রয়েছে, যাদের অন্য জায়গায় ঘর করে দেওয়ার কথা বলে প্রোমোটার এখানে এনে রেখেছে। কিন্তু ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও ওই সব পরিবার ঘর পায়নি।

সারা সকাল ছোটাছুটি করার পরে সন্ধ্যায় যখন অন্ধকার নামছে, ভয় যেন আরও বাড়ছে। এই পোড়া বস্তি আগলে কত ক্ষণ বসে থাকতে পারব জানি না। রাতেই বা আমরা
কোথায় যাব? না থাকল মাথার উপর ছাদ, না থাকল খাওয়াদাওয়ার কিছু। সবাই দু’-এক দিন পাশে থাকবেন, তার পর?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন