কখনও ক্রিকেটের ম্যাচে বাজি ধরা নিয়ে গোলমাল, আবার কখনও বকেয়া টাকা শোধ করতে না পারায় বন্ধুর হাতে ‘খুন’।
সবাই কিশোর, নাবালক। কেউ বন্ধুকে খুনে অভিযুক্ত। কেউ টিফিন নিয়ে বন্ধুর সঙ্গে বচসার জেরে আত্মঘাতী। শৈশবের এই অস্থিরতায় চিন্তিত মনোবিদ থেকে সমাজতত্ত্ববিদদের একাংশ। তবে তাঁদের আশা, অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়লে এড়ানো যাবে এমন ঘটনা।
পাথরে থেঁতলে দেওয়া দশ বছরের বালকের দেহ উদ্ধার হয়েছিল শনিবার, লিলুয়া থেকে। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশের অনুমান, ক্রিকেটের বাজির টাকার জন্য ওই কিশোরের সঙ্গে তার দুই বন্ধুর গোলমাল হয়। তারাই তাকে খুন করে। মাসখানেক আগে নদিয়ায় বকেয়া টাকা শোধ করতে না পারায় বন্ধুদের হাতে খুন হয়েছিল এক কিশোর। আবার দিন কয়েক আগে কলকাতায় বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া করে আত্মহত্যা করে ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রী।
মনোবিদদের একাংশ জানাচ্ছেন, বড় হয়ে ওঠার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এর কারণ। আধুনিক জীবনে যান্ত্রিক ভাবে বড় হচ্ছে শিশুরা। তাদের স্বাভাবিক, মানবিক আবেগগুলো ঠিক মতো পূর্ণতা পাচ্ছে না।
সমাজতত্ত্ববিদদের একাংশ জানাচ্ছেন, চারপাশের অস্থিরতা শিশু-কিশোরদের সুস্থ মানসিকতা তৈরি করছে না। প্রচার মাধ্যমে হিংসাকে তুলে ধরা হয়। তা দেখার ক্ষেত্রে নিষেধ নেই। তারা শুধু দেখছেই না, তাদের মন সেগুলি গ্রহণ করছে। যার ফলে তাদের চরিত্রেও থাকছে হিংসার ছাপ। পাশাপাশি, চাহিদার তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। তাতে হিসেবের সামান্য গোলমাল হলেই সামাল দিতে পারছে না শিশুমন।
পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে অভিভাবক, শিক্ষক এবং আশপাশের মানুষের সচেতনতার মাধ্যমে— এমনই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের পরামর্শ, বাড়ির পরিবেশ শিশুদের মন গঠনের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে। অভিভাবকদের কখনই বাড়ির বাচ্চাদের সামনে বচসা করা ঠিক নয়। সন্তানদের মারধর না করার পরামর্শও দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা।
তাঁদের আরও পরামর্শ, আলোচনা করে যে কোনও সমস্যার সমাধান করা যায়। হিংসা কোনও সমাধান নয়, বরং মারধর করলে সমস্যা বাড়বে এটা শেখানো দরকার। সন্তানকে মারধর করলে তারা শেখে না। বরং তাদের মনে চাপ পড়ে। সেই হিংসা তারা অন্যের উপরে প্রকাশের চেষ্টা করে।
মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল বলছেন, যে শিশুরা তাড়াতাড়ি ধৈর্য হারায়, সামান্য কারণে ভাঙচুর করে, তাদের নিয়ে বাড়তি সচেতন হওয়া জরুরি। এই প্রসঙ্গে মনোবিদ জয়রঞ্জন রামের পরামর্শ, ‘‘প্রথমেই প্রাণ কেড়ে নেওয়ার মতো অপরাধ কোনও শিশু করে না। তার মনে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে ওঠে। অভিভাবকেরা সচেতন হলে প্রথমেই তা কমানোর চেষ্টা করা যায়। ছোট থেকেই সৃজনশীল কাজের মধ্যে যুক্ত হতে শেখাতে হবে। গড়তে শিখলে ভাঙার প্রবণতাও কমবে।’’
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সমাজতাত্ত্বিক ডালিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘‘ইচ্ছে পূরণের জন্য যা-খুশি-তাই করা যায় না। অপছন্দের পরিস্থিতিতেও সহনশীল হতে হয়, সেটা সন্তানদের শেখাতে হবে। না শিখলে যে পরিণতি ভাল হয় না, শৈশব থেকে শেখাতে হবে অভিভাবকদেরও।’’