মহাষষ্ঠীর দিন। দুপুরে জমিয়ে পংক্তিভোজন করা গেছে। তাই মনমেজাজ বেশ খুশি-খুশি। ভেটকি ভাজার কথা ভোলা যাচ্ছে না। ঝিঙে-আলুপোস্তটাও মুখে লেগে আছে। নিজ হাতে তোলো আর খাও। সুযোগ পেয়ে নিজের প্রতি এতটুকু অবিচার করিনি। তা ছাড়া, ভুললে চলবে কেন, আজ আমার বিচারকের ভূমিকা।
উত্তর কলকাতায় যেতে হবে শুনে হরষে-বিষাদে একটু তেতে উঠলাম। বহু বছর এদিককার পুজো দেখা হয়নি। সেই যখন কলেজে পড়তাম, কোথাও কাশের গুচ্ছ নেই, অথচ রাস্তায় রাস্তায় আলোর সাজে পুজো আসছে দেখে প্রথম প্রথম চমক লাগত। এখন আমি নিজেই, ধূসর আকাশের নীচে, ভোরের শিশির আর কাশের গুচ্ছের অভাব সমেত শারদোৎসব করি।
রাজহাঁসের চলার মতো সাদা মসৃণ গাড়িগুলো একের পর এক সারিবদ্ধ ভাবে আমাদের নিয়ে পথে নামল। পার্লে আনন্দবাজার পত্রিকা শারদঅর্ঘ্য ১৪২১’-এর এই বিচার আয়োজনের যাঁরা উদ্যোক্তা, তাঁদের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না যাতে আমাদের চলা প্রতিরোধহীন হয়। পুলিশি নিরাপত্তাও ছিল সঙ্গে। তবু কাজটি সহজ নয়। একে তো কলকাতায় পুজোর সময় পথঘাট বেড়াবেড়ি করে শীর্ণ হয়ে আসে, কোথাও রাস্তা বন্ধ, কোনওটা একমুখী। ষষ্ঠীর দিন, আপিস-কাছারি ব্যবসা-বাণিজ্য সমস্তই খোলা। পথে যান এবং লোকচলাচলের কমতি নেই। এমনকী, বহু জন পুজোর কেনাকাটা সেরেছেন এই দিনে। দোকানে দোকানে দরদস্তুর চলছে। ফুটপাথে ঝলমলে নতুন পোশাক রাশি রাশি টাঙানো। নতুন বাহারি জুতো সুতোয় বাঁধা অল্প অল্প দুলছে শরতী হাওয়ায়। এবং এই বিকেলেই অনেকে সেজেগুজে বেরিয়ে পড়েছেন বেলাবেলি প্রতিমাদর্শন সেরে নেবেন বলে। বাচ্চার হাত ধরে মা, ছেলে কোলে করে সুসজ্জিতা বউ সামলে সংসারী পুরুষ, প্রেমিকার কোমর জড়িয়ে প্রেমিক। সাজে পোশাকে, হাবেভাবে দর্শকেরাও দর্শনীয়।
এমন মানুষে যানবাহনে মিশে আমাদের শকট হংসবাহিনী যে নির্বিঘ্নে পথ চলছে, তার কৃতিত্ব পুরোপুরি সেই সব যুবক উদ্যোক্তাদের, যাঁরা বাইকে ছোটাছুটি করে, প্রয়োজনে পথে নেমে, চেঁচিয়ে বিচারের পথ প্রশস্ত করছিলেন। পুলিশের ভূমিকাও ছিল প্রশংসনীয়। স্বীকার করতেই হয়, ভিড় সামলাতে কলকাতা পুলিশের দক্ষতা প্রশ্নাতীত।
নির্বাচনের চূড়ান্ত এই পর্যায়ে পাঁচটি মণ্ডপ ও প্রতিমা পরিদর্শনের কথা আমাদের। হাতিবাগানে নলিন সরকার স্ট্রিট সর্বজনীনের মণ্ডপে প্রথমে যাওয়া হল। আয়না ও রঙিন কাচের টুকরোয় গড়ে উঠেছে উদ্ধত মানবের ক্রমান্বয়ী আত্মোপলব্ধির ইতিবৃত্ত। সেই সব আমাদের নিয়ে চলল অহংবোধের অসাড়তা থেকে শক্তির পাদপদ্মে আত্মসমর্পণের মহিমায়। এবং দেবীমৃর্তি এখানে অনন্যস্বরূপিণী। রঙের ব্যবহার, রূপের কল্পিত নির্মাণ, অভিব্যক্তি এবং ভাস্কর্যের শৈল্পিক আনুপাতিক সামঞ্জস্যবোধের সম্যক প্রয়োগে এই মূর্তি এক অপূর্ব কীর্তি! এর পর আরও কয়েকটি প্রতিমাও বড় ভাল লেগেছিল। প্রশংসনীয় মৃৎশিল্প, অপরূপ শৈলী, তবু সেই প্রথম দেখা প্রতিমার অতুলনীয় উপস্থিতি মনে লেগে রইল। সেই দেবীর বসনপ্রান্ত, নিখুঁত কুঁচির ভাঁজ হিংস্র সিংহে রূপান্তরিত হয়ে যাবতীয় অপশক্তির বিরুদ্ধাচারী। অবহেলিত, ব্যঙ্গব্যথিত নারীশক্তির নিখুঁত প্রতীক!
মণ্ডপসজ্জায় রঙিন কাচ, আয়না এবং ধাতুর ব্যবহার চক্ষু ক্লান্ত করে তুলছিল। এখন চলছে থিম-পুজোর ফ্যাশন। তাতে অভিনবত্ব আনতে গিয়ে নানান সামগ্রী, নানান শৈলীর অভিনব প্রয়োগ ঘটছে। এতে দু’টি বৈশিষ্ট্য প্রধান। এক, মণ্ডপসজ্জার মধ্যে বৃহত্ব এসেছে, যাকে বলে মস্ত বড়। দুই, আলোর ব্যবহার প্রত্যক্ষ থেকে পরোক্ষ হয়েছে, সুভাবিত, সুপ্রযুক্ত। কিন্তু সব ক্ষেত্রে সামগ্রিকতায় তা সার্থক হয়নি। বৃহত্ব এবং ধাতব উপকরণ এই দুইয়ের মধ্যেই যে কাঠিন্য আছে, তাকে অতিক্রম করে শিল্পে উন্নীত করা অত্যন্ত শক্ত কাজ।
আমাদের চোখ, আমাদের মন স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে দিল উল্টোডাঙা সংগ্রামীর পুজো। দক্ষিণ ভারতীয় শৈলীতে সজ্জিত তাদের মণ্ডপ। দেবীও মানানসই। পরিবেশের মধ্যে পূজার নান্দনিকতা রচিত ছিল। লাউডস্পিকারে বেজে চলেছিল দক্ষিণ ভারতীয় শাস্ত্রীয় গীত। ঘুরে ঘুরে অনেকক্ষণ ধরে দেখলাম। কত তুচ্ছ সামগ্রী দিয়ে এদের সজ্জা, অথচ কী মনোরম! মাটির ঘট, প্রদীপ, কলস তাতে আল্পনা আঁকা। অজস্র ফুলে ফুলে ভরা। প্লাস্টিকের জলের বোতল কেটে তৈরি করা ফুল অপূর্ব সুন্দর। বোতল ধোয়ার ব্রাশ এবং সাইকেলের চাকা সাজিয়ে তোলার রঙিন ফুল ব্যবহৃত হয়েছে গভীর শিল্পবোধে। মনে হচ্ছিল এ জায়গার তুলনা নেই।
কিন্তু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল দারুণতর বিস্ময়। কাঁকুড়গাছির যুবকবৃন্দের মণ্ডপে আমরা বিমুগ্ধ হয়ে গেলাম। জগন্নাথের রথযাত্রা অপরূপ শিল্পসুষমায় দেবী দুর্গার পূজামণ্ডপ হয়ে ধরা দিল। অনবদ্য তাদের মাধুর্য। অপূর্ব নির্মাণ। রথের মেলার প্রেক্ষাপট থেকে, দোতলার বারান্দায় রথ দেখার অভিপ্রায়ে উপস্থিত গৃহিণী পর্যন্ত নিখুঁত। প্রত্যেকটি মূর্তিতে যত্ন, প্রত্যেক কারুকাজে দক্ষতা, প্রতিটি পুতুল প্রাণবন্ত আর দেশীয় শিল্পভাবনায় মহিমান্বিত। এমনকী রথের মেলায় যা না পেলেই নয়, সেই পাঁপড়ভাজা আর মিঠাইও ছিল। সমগ্রে এমন পূর্ণতা সহজে চোখে পড়ে না।
দেখা ফুরোল। পথ চলতে চলতে আরও কত শিল্পসমন্বিত মণ্ডপ চোখে পড়ল। হয়তো ব্যতিক্রমী নয়, তবু সুন্দর। কথা হল কত। কত সমাদর, আপ্যায়ন। পথপার্শ্বে দর্শনার্থীর ধৈর্য্যশীল প্রতীক্ষা সেও ভারী সুন্দর। তাঁদের জন্যই এই শিল্প। এই সেজে ওঠা। মাত্র সাত দিনের। কিন্তু তার রেশ থাকবে সারা বছর। প্রতীক্ষাও থাকবে। আসছে বছর আবার এসো উমা। শিউলি ফুটলেই।