খানপুর রোড

এখনও ভালবাসার টান প্রবাসীকে ফিরিয়ে আনে

রবিবার সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিতেই হোয়্যাট্সঅ্যাপ-এ মেসেজটা দেখে মনটা খুশিতে ভরে উঠল। দীর্ঘ দিন বিদেশে কাটিয়ে আবারও টুবলুদা সপরিবার পাড়ায় ফিরে আসছেন।

Advertisement

শুভ্রজ্যোতি মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৬ ০২:১১
Share:

রবিবার সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিতেই হোয়্যাট্সঅ্যাপ-এ মেসেজটা দেখে মনটা খুশিতে ভরে উঠল। দীর্ঘ দিন বিদেশে কাটিয়ে আবারও টুবলুদা সপরিবার পাড়ায় ফিরে আসছেন। সেই পাড়ার টানে, পরিচিত মুখগুলোর টানে। ইতিমধ্যেই খবরটা পাড়াতুতো দাদা আর বন্ধুদের মুখে মুখে পাড়াময় ছড়িয়ে প়ড়ায় আশপাশের প্রতিবেশীরা সকলেই উৎসাহিত, আনন্দিত। এটাই আমার পাড়া যেখানে মানুষে মানুষে অন্তরের টান ধরে রেখেছে সম্পর্কের সেতুটা।

Advertisement

খানপুর রোড সেই পাড়াটা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু রোডে, দমকলের পাশ ঘেঁষে শুরু হয়ে পাকদণ্ডীর মতো ঘুরে এক দিকে সুকান্ত সরণিতে, অন্য দিকে অশোক অ্যাভিনিউতে গিয়ে মিশেছে। পাশেই নাকতলা এলাকা।

গত ৩৮ বছর এখানেই বসবাস। আজও মনে করি পাড়া একটা বৃহত্তর পরিবার। তার প্রমাণও মেলে যখন বিপদেআপদে পাড়া-পড়শি ঝাঁপিয়ে পড়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। লোকবলের অভাবে কাউকে এখানে অসহায় বোধ করতে হয় না। পাড়ায় পাড়ায় যখন শোনা যায় সম্পর্কের অবক্ষয়ের কথা সেখানে আজও এ পাড়ায় রয়েছে উষ্ণ সম্পর্কের বন্ধন। বাসিন্দাদের মধ্যে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকলেও তা নিয়ে কোনও বিভাজন নেই।

Advertisement

আগে এখানে ছিল দেশভাগের রক্তক্ষয়ী অভিজ্ঞতায় ভিটেমাটিহারা মানুষের বসবাস। মধ্যবিত্ত সেই পাড়াটায় সময়ের সঙ্গে এসেছেন উচ্চমধ্যবিত্তরাও। বড় রাস্তার আশেপাশে তৈরি হয়েছে ঝাঁ চকচকে অসংখ্য দোকান। ফলে এলাকার অর্থনৈতিক অবস্থার উত্তরণ ঘটেছে। আগে এখানে ছিল বেশ কিছু কারখানা। এখনও কিছু কারখানা থাকলেও বদলেছে তার চেহারাটা। কাছাকাছির মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি স্কুল।

আজ পাড়াটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। নাগরিক পরিষেবাও উন্নত হয়েছে। নিয়ম করে রাস্তা পরিষ্কার, জঞ্জাল অপসারণ হয়। ছড়ানো হয় ব্লিচিং আর মশার তেলও। নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পাড়ার চেহারাটা চোখে পড়ার মতোই। তবুও কিছু আক্ষেপ রয়েই গিয়েছে। বহু চেষ্টা করেও পুকুর পাড়টা সংস্কার করা যায়নি। সেখানে জমে থাকে আবর্জনার স্তূপ। ঝাঁ চকচকে পাড়াটার মধ্যে ওই জায়গাটুকুই বড় বেমানান। কাউন্সিলর মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তীকে যে কোনও সমস্যায় পাশে পাওয়া যায়। আগে পানীয় জলের সমস্যা থাকলেও কাছেই নাকতলায় বুস্টার পাম্পিং স্টেশন তৈরি হওয়ায় সেই সমস্যা এখন কমেছে।

কাছাকাছির মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি ছোটখাটো মাঠ। আগের তুলনায় কমলেও এখনও বিকেলে কচিকাঁচাদের খেলতে দেখা যায়। তবে কোচিং এর চক্রব্যূহে স্কুল থেকে ফিরে মাঠে যাওয়ার অভ্যাসটা কমে এসেছে। তেমনই ভাল উদ্যোক্তার অভাবে কমেছে পাড়ার ফুটবল টুর্নামেন্ট, ক্রিকেট ম্যাচ।

এ পাড়ার পুজোর আকর্ষণ এমনই যে বেশির ভাগ পাড়া-পড়শি পুজোর ক’দিন পাড়া ছেড়ে অন্যত্র যান না। পুজোটা আজও আটপৌরে পাড়ার পুজোই আছে, আধুনিকতার প্রভাবে কর্পোরেট পুজো হয়ে যায়নি। পুজোর তিন দিন এক সঙ্গে খাওয়াদাওয়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খাবারের স্টল দেওয়া সব আগের মতোই আছে। এমনকী যাঁরা পাড়া ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন তাঁরাও পুজোর সময়ে ফিরে আসেন। তবে একটা জিনিস দেখে অবাক হই, নতুন যাঁরা ফ্ল্যাট কিনে এ পাড়ায় এসেছেন তাঁদের অনেকেই পুজোয় সামিল হন না। নিজেদের
গুটিয়ে রাখেন।

বাড়তে থাকা কর্মব্যস্ততায় পাড়ার যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ কিংবা বাড়িতে আসা যাওয়ার অভ্যাসটা কমলেও যোগাযোগটা আছে হোয়্যাট্সঅ্যাপ গ্রুপে। শুধু তাই নয়, এ পাড়ার একটা নিজস্ব হোয়্যাট্সঅ্যাপ গ্রুপ আছে। তাতে স্থায়ী বাসিন্দা থেকে কর্মসূত্রে প্রবাসীরাও পাড়া নিয়ে মতামত বিনিময় করেন। তবে মাঝবয়সি আর প্রবীণদের মধ্যে যোগাযোগটা আগের মতোই আছে পাড়ার আড্ডার দৌলতে।

আশেপাশে যখন এত বিনোদনের হাতছানি তখনও নিয়মিত আড্ডা বসে পাড়ার মাঠে, রকে কিংবা বাড়ির সামনে। সকালে বিকেলে যেমন মাঝবয়সি আর প্রবীণরা আড্ডা দেন, তেমনই আমাদের কয়েক জনের আড্ডাটা রোজই বসে রাত দশটার পরে মাঠে। আড্ডাটা আছে বলেই পাড়া-পড়শির খোঁজ-খবর নেওয়ার অভ্যাসটা আজও আছে।

অন্য পাড়ার মতোই এখানেও একটা একটা করে পুরনো বাড়ি ভেঙে তৈরি হচ্ছে বহুতল। আসছেন নতুনরা। তাঁদের মধ্যে যাঁরা মিশুকে তাঁরা পুরনোদের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছেন। বাকিরা নিজেদের মতোই থাকতে পছন্দ করেন। সময়ের সঙ্গে এক দিকে যেমন জনসংখ্যা বেড়েছে তেমনই বেড়েছে গাড়ির সংখ্যাও। বেশির ভাগ বাড়িতে গ্যারাজ না থাকায় রাতে রাস্তাতেই গাড়ি থাকে। তবে পার্কিং সমস্যা সে ভাবে নেই।

ছেলেবেলার পাড়াময় দাপিয়ে খেলে বেড়ানো, নির্জন দুপুরে আম, জাম, জামরুল, পেয়ারা পাড়তে গাছে ওঠাই ছিল জীবন। ঢিল মেরে আম পাড়া কিংবা ক্রিকেট খেলতে গিয়ে প্রতিবেশীর জানলার কাঁচ ভেঙে দে দৌড়। আগে পাড়ার বন্ধুদের মধ্যে গল্পের বই আদানপ্রদানেরও রেওয়াজ ছিল। মনে পড়ছে পুজোয় আমরা পরিকল্পনা মাফিক একটি করে শারদীয়া পত্রিকা কিনে অদল বদল করে পড়তাম।

পাড়ার যুব সম্প্রদায়ের অনেকেই আজ কর্মসূত্রে বাইরে। তাই পাড়াটা অনেক সময় ফাঁকা ফাঁকা লাগে। সেই সব অভিভাবকদের জীবনটা এখন নিঃসঙ্গতায় পরিপূর্ণ। এক সময় কাছাকাছি থাকতেন অভিনেতা বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়, আর এন এস সি বসু রোডে যেখানে স্টেট ব্যাঙ্ক সেখানেই একটি বাড়িতে থাকতেন ছবি বিশ্বাস। এ পাড়াতেই থাকতেন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী মাখনলাল ঘোষদস্তিদার, আইনজীবী অশোক দে প্রমুখ।

অনেক বদলালেও ফিকে হয়নি সম্পর্কের বন্ধন। তাই তো প্রবাসী প্রতিবেশীর ঘরে ফেরা আজও হাসি ফোটায় পাড়া-পড়শির মুখে। অনাত্মীয়ের আত্মীয়তা আর সম্পর্কের উষ্ণতা ধরে রেখেছে পাড়ার নিজস্ব চরিত্রটা।

লেখক চিকিৎসক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন