বে-হুঁশ: হাতিবাগানের ফুটপাত ঢাকা হকারদের প্লাস্টিকে। সোমবার। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য
ফুটপাত, তুমি কার?
বহুচর্চিত প্রশ্নটা ক্লিশে শোনাতে পারে। তবে তার প্রাসঙ্গিকতা একফোঁটাও ফিকে হয়নি। মাস তিনেক আগে বাগড়ি মার্কেটের অগ্নিকাণ্ড এবং গড়িয়াহাট মোড়ের টাটকা বিপর্যয়ের অভিঘাত সেই চেনা প্রশ্নটাই খুঁচিয়ে তুলছে। গোটা শহরের ফুটপাতই যেন পরস্পরের প্রতিবিম্ব। ভিড়, ঠাসাঠাসি দখলদারি আর রকমারি দাহ্য পদার্থে বিপদের হাতছানিতে যেন পরস্পরকে টেক্কা দেওয়ার প্রতিযোগিতা।
সোমবার দুপুরের হাতিবাগান বাজার। গোটা ফুটপাত জুড়েই প্লাস্টিকের আচ্ছাদন। ২০১২ সালে ভয়াল আগুনে ভস্মীভূত হয়েছিল হাতিবাগান বাজারের একাংশ। সংস্কারের পরে নতুন করে চালু হওয়া ওই বাজারের মুখটাও হকারদের দখলে। সর্বত্র প্লাস্টিকের ছাউনির জঙ্গল। ‘হাতিবাগান বাজার মার্চেন্টস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক রঞ্জন রায় বললেন, ‘‘ফুটপাতের ডালা থেকে একের পর এক আগুন লাগার ঘটনায় আমরা শঙ্কিত। ফুটপাতে যে রকম বিপজ্জনক ভাবে প্লাস্টিক ঝুলছে, তাতে যে কোনও সময়ে বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। প্রশাসনকে বারবার বলেও কাজ হয়নি।’’ তাঁর দাবি, ‘‘হকারদের এই প্লাস্টিক নিয়ে পুর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। তাতে সাড়া মেলেনি।’’
হাতিবাগান থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশেও দেখা গেল, ফুটপাত বলে কিছুই নেই। সর্বত্রই হকারদের দখলদারি। শ্যামবাজার মার্কেটে ঢোকা, বেরোনোর ছ’টি গেটই হকারদের দখলে। বাজার লাগোয়া ফুটপাতে পথচারীদের চলাফেরার জায়গা নেই। সাধারণ মানুষের হাঁটাচলার জন্য রাজপথের একাংশ গার্ডরেলে ঘিরেছে কলকাতা পুলিশ। ‘শ্যামবাজার মার্চেন্ট কমন ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক তারকচন্দ্র দাস বলেন, ‘‘আমাদের বাজারে ৪২৯টি স্টল রয়েছে। বাজারের সামনে ফুটপাত দখল করে হকারেরা বিপজ্জনক ভাবে রয়েছেন। প্লাস্টিকের মতো দাহ্য বস্তুতে ফুটপাত ভর্তি।’’ শ্যামবাজারের এক ব্যবসায়ীর অভিযোগ, ‘‘একটা সুইচেই ফুটপাতের সব স্টলে আলো জ্বলে। এটাই সব থেকে বিপজ্জনক। যত্রতত্র তার বেরিয়ে থাকায় শট সার্কিট হওয়ার জোর আশঙ্কা।’’
কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতে খাবারের স্টলে চলছে রান্না। সোমবার।
কলেজ স্ট্রিটের ‘বর্ণপরিচয়’ বাজারের উল্টো দিকে একটি নামী কাপড়ের দোকানের সামনেই ফুটপাতে গ্যাস সিলিন্ডার রেখে রোল-চাউমিনের দেদার বিক্রি চলছে। এমন বিপজ্জনক ভাবে গ্যাস জ্বালিয়ে রান্না হচ্ছে কেন? শুনে জনৈক কর্মীর ভাবলেশহীন জবাব: ‘‘কুড়ি বছর ধরে এ ভাবেই চলছে।’’
চিৎপুর থেকে বড়বাজারের দিকে যেতেও এক দৃশ্য। চিৎপুর রোডেও সাধারণ মানুষকে পথ করে দিতে রাস্তার এক পাশে গার্ডরেল বসানো হয়েছে। বড়বাজারের যমুনালাল বজাজ স্ট্রিটে ফুটপাত উপচে রাজপথে উঠে এসেছে হকারদের ডালা। পগেয়াপট্টি, আর্মেনিয়ান স্ট্রিটও প্লাস্টিকে মুখ লুকিয়েছে। বিপদের সময়ে এই প্লাস্টিকে ঢাকা ডালার মধ্য দিয়ে এগোতে বারবার হিমশিম খেয়েছে দমকল। ধর্মতলা চত্বরেও একই দৃশ্য। বছর কয়েক আগে ভয়াবহ আগুনে চাঁদনি বাজার পুড়ে গিয়েছিল। চাঁদনির এক ব্যবসায়ীর আশঙ্কা, ‘‘বাগড়ির মতো বড় বিপদ এখানেও হতে পারে।’’
শহর জুড়ে এই জতুগৃহ দেখেও কেন মুখ ফিরিয়ে পুর প্রশাসনের কর্তারা? কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (বাজার) আমিরুদ্দিন ববি জানিয়েছেন, বিপজ্জনক প্লাস্টিক সরানোর জন্য তাঁরা ইতিমধ্যেই বৈঠক করেছেন। মেয়র ফিরহাদ হাকিম বা দমকলমন্ত্রী সুজিত বসুও মানছেন, শহরের বিভিন্ন বাজারে প্লাস্টিক ছাউনি জতুগৃহের চেহারা নিয়েছে। সুজিত বলছেন, ‘‘দরকারে ফুটপাত দখলমুক্ত করতে পুরসভাকে কিছু পরামর্শ দেবে দমকল।’’ প্লাস্টিক ছাউনি এবং বিদ্যুতের তারের জট— দুটোই সমস্যা বলে মনে করেন তিনি। দমকলমন্ত্রীর কথায়, ‘‘গরিব মানুষ নিশ্চয়ই ব্যবসা চালাবেন। কিন্তু প্লাস্টিক দিয়ে রাস্তা ঢেকে টেবিল-চেয়ার ফেলে জবরদখল চলবে না। পুরনো কলকাতা ও সেক্টর ফাইভ— সর্বত্রই এই সমস্যা। ট্রলি পেয়েও হকারেরা ফুটপাত দখল করছেন।’’ মেয়রও বলছেন, ‘‘প্রথমে গড়িয়াহাটে প্লাস্টিক সরানো হবে। তার পরে অন্য বাজারেও হাত পড়বে।’’
বিপর্যয়ের ধাক্কায় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস সত্ত্বেও সত্যিই শহরের ফুটপাত-চিত্র আদৌ পাল্টাবে কি না, তা নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ রয়েছে।