Air Pollution in Kolkata

সবুজ ময়দানের গায়েই কলকাতায় সবচেয়ে বেশি দূষণ! শহরের ফুসফুসে এত বিষ ঢালছে কে?

রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের রিপোর্ট বলছে, বুধবার সকাল ১১টার রিপোর্ট অনুযায়ী ভিক্টোরিয়া চত্বরে বাতাসে ভাসমান সূক্ষ্ম ধূলিকণার গড় (পিএম ২.৫) ৩০২। যা কলকাতার বাকি এলাকাগুলির থেকে বেশি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:৩৭
Share:

বিগত দু’-তিন দিন বেলা ১২টা নাগাদ বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার পরিমাণ সব থেকে বেশি ছিল ভিক্টোরিয়া সংলগ্ন এলাকাতেই। ফাইল চিত্র।

বুধবার কলকাতার সবচেয়ে দূষিত এলাকা শহরের ‘ফুসফুস’ ময়দান চত্বর। মঙ্গলবারও তাই ছিল। গত সোমবারও। এমনটাই বলছে রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের পরিসংখ্যান। রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের রিপোর্ট বলছে, বুধবার সকাল ১১টার রিপোর্ট অনুযায়ী, ভিক্টোরিয়া চত্বরে বাতাসে ভাসমান সূক্ষ্ম ধূলিকণার গড় (পিএম ২.৫) ৩০২ (অত্যন্ত খারাপ)। যা কলকাতার বাকি এলাকাগুলির থেকে বেশি। বিগত দু’-তিন দিন বেলা ১২টা নাগাদ বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার পরিমাণ সব থেকে বেশি ছিল ভিক্টোরিয়া সংলগ্ন এলাকাতেই। অর্থাৎ, গত কয়েকদিনের হিসাব অনুযায়ী, ওই এলাকায় গিয়ে ‘বিষবায়ু’ গ্রহণ করছেন কলকাতার সাধারণ মানুষ। এই পরিস্থিতিতে সকালের দিকে ময়দানে প্রার্তভ্রমণে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র।

Advertisement

সকাল-বিকাল মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নেওয়ার জন্য ভিক্টোরিয়া চত্বরে ভিড় জমান বহু মানুষ। সন্তানরা যাতে খোলা আকাশের নীচে প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারে, তার জন্য বাবা-মায়েদেরও পছন্দের জায়গা ময়দান চত্বর। কিন্তু এ রকম খোলামেলা হওয়া সত্ত্বেও কেন ময়দান এলাকার বাতাসের মান এত খারাপ? এর জন্য ময়দান সংলগ্ন ধর্মতলা চত্বরকেই খানিকটা দায়ী করছেন পরিবেশ বিজ্ঞানী স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী। পাশাপাশি, ওই এলাকায় দিন দিন গাছের পরিমাণ কমে যাওয়াকে দূষণ বাড়ার অন্যতম কারণ বলেও মনে করেন তিনি।

স্বাতীর কথায়, ‘‘ভিক্টোরিয়া চত্বরে আগে যে পরিমাণ গাছ ছিল তা অনেক কমেছে। ওই এলাকার চারদিকে রাস্তা। তাই দূরপাল্লার সব বাস ময়দানের পাশ দিয়েই ধর্মতলা চত্বরে প্রবেশ করে। বাসগুলি থেকে নির্গত ধোঁয়া বাতাসকে আরও দূষিত করে তুলছে। এ ছাড়াও ওই চত্বরে অনেকে রান্না করেন। চটজলদি খাবারের বহু অস্থায়ী দোকানও গজিয়ে উঠেছে ওই এলাকায়। সেই দোকানগুলিতে ধোঁয়া পরিশোধন করার চিমনি ব্যবহার হয় না। অনেকে ময়দানে গিয়ে ঘাস পোড়ান। এই সব কারণেই এই চত্বরে দূষণের পরিমাণ বেশি।’’

Advertisement

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

তবে মানুষের তৈরি কারণের পাশাপাশি, ভিক্টোরিয়া এলাকার দূষণ বৃদ্ধির জন্য আবহাওয়া এবং কলকাতার মধ্যে এই এলাকার ভৌগোলিক অবস্থানকেও দায়ী করেছেন দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ।

তিনি বলেন, ‘‘ভিক্টোরিয়া এলাকায় দূষণ কেন বেশি তার জন্য এর ভৌগোলিক অবস্থান জানা প্রয়োজন। কলকাতায় যে জায়গাগুলিতে গাড়ির আনাগোনা বেশি, তার মধ্যে ময়দান চত্বর অন্যতম। এই দূষণ অনেকটা আবহাওয়ার কারণেও বেড়েছে। দূষণ বেশি মানে ওই জায়াগা দূষণের উৎপত্তিস্থল, এমনটা নয়। ভিক্টোরিয়ার উত্তরে রয়েছে ধর্মতলা। এই সময় উত্তর দিক থেকে দক্ষিণে ভিক্টোরিয়ার দিকে হাওয়া বইছে। ফলে ধর্মতলার চত্বরে ধূলিকণা হাওয়ায় ভেসে ভিক্টোরিয়ার দিকে আসার প্রবণতা থাকে। ধর্মতলা চত্বরে অনেক বেশি গাড়ি যাতায়াত করে, ফলে ধূলিকণার পরিমাণ এব‌ং দূষণ বেশি। সেই ধূলিকণা ধর্মতলা থেকে ভিক্টোরিয়ার দিকে এসে দূষণের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। হাওয়ার গতিবেগ কম হওয়ায় ধূলিকণা আটকে থাকছে ওই এলাকাতেই। ফলে দূষণের মাত্রা বাড়ছে।’’

একই সঙ্গে শীতকালে ময়দানের আশপাশের পাতা পোড়ানো এবং সম্প্রতি গঙ্গাসাগর মেলা উপলক্ষে পুণ্যার্থী সাধুদের কাঠ পোড়ানোকেও ময়দান চত্বরে দূষণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হিসাবে দেখছেন কল্যাণ। এই আবহে মনুষ্যসৃষ্ট দূষণ নিয়ন্ত্রণের দিকে জোর দেওয়ার কথাও জানিয়েছেন তিনি।

শহরের দূষণ নিয়ন্ত্রণ না করলে অদূর ভবিষ্যতে কলকাতার অবস্থা কি দিল্লির মতো হয়ে যেতে পারে? ফাইল চিত্র।

ময়দান এলাকার পাশাপাশি, দূষণ নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে কলকাতার যাদবপুর এলাকাও। বুধবার যাদবপুর এলাকায় বাতাসে ভাসমান সূক্ষ্ম ধূলিকণার গড় ২৯১। তুলনামূলক ভাবে বাতাসের মান ভাল শহরের রবীন্দ্র সরোবর এবং ফোর্ট উইলিয়াম চত্বরে। ওই দুই এলাকায় ভাসমান সূক্ষ্ম ধূলিকণার গড় থাকছে ১২০ থেকে ১৩০-এর আশপাশে।

বাতাসে মূলত দু’প্রকারের ধূলিকণা থাকে। পিএম ২.৫ এবং পিএম ১০। পিএম ২.৫ -এর অর্থ ২.৫ মাইক্রন ঘনত্বের সূক্ষ্ম ধূলিকণা এবং পিএম ১০-এর অর্থ ১০ মাইক্রন ঘনত্বের অপেক্ষাকৃত বড় ধূলিকণা। শীতে এই দু’ধরনের ধূলিকণায় কলকাতার বাতাস ভরে গিয়েছে। কিন্তু ১০ মাইক্রন ঘনত্বের ধূলিকণা শ্বাসনালিতে প্রবেশের আগে তা অনেক ক্ষেত্রেই আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু উদ্বেগের আসল কারণ ২.৫ মাইক্রন ঘনত্বের সূক্ষ্ম ধূলিকণা। নিশ্বাস নেওয়ার সময় খুব সহজেই এই সূক্ষ্ম ধূলিকণা ফুসফুসে প্রবেশ করতে পারে। হাঁপানি, শ্বাসকষ্টের মতো ফুসফুসজনিত অসুখ হওয়ার প্রধান কারণ হিসাবে মূলত পিএম ২.৫-কেই দায়ী করেন বিজ্ঞানীরা। চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানীদের মতে, এই মরসুমে শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত যাবতীয় অসুখের নেপথ্যে রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত দূষণ।

দিল্লিতে প্রতি বছর দূষণের পরিমাণ মাত্রা ছাড়াচ্ছে। পাশাপাশি দিল্লি পার্শ্ববর্তী এনসিআর-এর বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষও দূষণের কারণে জেরবার। শীতের মরসুম শুরুর আগে দিল্লির বাতাস ‘শ্বাস নেওয়ার অযোগ্য’ বলেও ঘোষণা করা হয়েছিল। শহরের দূষণ নিয়ন্ত্রণ না করলে অদূর ভবিষ্যতে কলকাতার অবস্থা দিল্লির মতো হয়ে যেতে পারে বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করছেন বিজ্ঞানীরা। বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে লড়াই জোরদার করতে ইতিমধ্যেই সক্রিয় হয়েছে পরিবেশ মন্ত্রক। তার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা। কেন্দ্রের লক্ষ্য, ২০২৪ সালের মধ্যে প্রাথমিক ভাবে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার পরিমাণ (পিএম ২.৫) জাতীয় স্তরে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন