কলকাতার হাওয়া বিষিয়ে যাওয়ার পিছনে যানবাহনকে বহু দিন ধরেই দুষছেন পরিবেশবিদেরা। কিন্তু গাড়ির বাইরেও দূষণের উৎস কম নেই। বুধবার মার্কিন তথ্য কেন্দ্রে কলকাতার বায়ু দূষণ নিয়ে এক আলোচনাসভায় উঠে এল এমনই নানা তথ্য। পরিবেশবিদদের অনেকেই বলছেন, নির্মাণস্থল, জঞ্জালের স্তূপ ও সেই আবর্জনায় আগুন ধরানো কিংবা নিকাশি নালা, এগুলি থেকেও কিন্তু হাওয়া দূষিত হয়। তাই কলকাতায় বায়ু থেকে বিষ দূর করতে হলে শুধু গাড়ির দূষণ কমালেই হবে না। বাকি উৎসগুলির বিরুদ্ধেও সমান নজরদারি প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।
কলকাতায় বায়ুদূষণ যে মারাত্মক হারে বাড়ছে, তা কয়েক বছর আগেই জানিয়েছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। সেই দূষণের প্রভাবে নাগরিকদের মধ্যে হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধির প্রকোপ বাড়বে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন পরিবেশবিদ ও জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা। পরবর্তী কালে একাধিক পরিবেশ গবেষণা সংস্থার রিপোর্টেও একই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই সব রিপোর্টের পরে যানবাহনের ধোঁয়াকেই বায়ু দূষণের জন্য মূলত দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন পরিবেশকর্মীদের অনেকে। কিন্তু পরিবেশবিদদের অনেকেই বলছেন, গাড়ির ধোঁয়া বিষ ছড়াচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বাকি উৎসগুলিও কম দোষী নয়।
জাতীয় পরিবেশ প্রযুক্তি গবেষণা সংস্থা (নিরি)-র বিজ্ঞানী দীপাঞ্জন মজুমদারের মতে, মেরামতি না হওয়া ভাঙাচোরা রাস্তা নির্মাণকাজ থেকে ওড়া কংক্রিটের ধুলোই এখন বায়ুদূষণের বড় উৎস হয়ে উঠছে। এর পাশাপাশি খাস কলকাতা লাগোয়া মহানগরীর এলাকাগুলির বিভিন্ন কলকারখানার ধোঁয়া, ঘিঞ্জি বস্তি এলাকার প্রকাশ্যে কয়লা-কাঠ পুড়িয়ে উনুন জ্বালানো, হট মিক্সিং প্লান্ট (ঢালাইয়ের মশলা তৈরির যন্ত্র) এবং জঞ্জালের স্তূপও চিন্তার বিষয়।
পরিবেশবিদেরা বলছেন, ভাঙাচোরা রাস্তা, নির্মাণস্থলের কংক্রিট আলগা ধুলো থাকে। সেই ধুলোই বাতাসে মিশছে। বাতাসে মিশে থাকা অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা সরাসরি মানুষের শ্বাসযন্ত্রে ঢুকে পড়ছে। বায়ুদূষণের সঙ্গে স্নায়ুরোগের সম্পর্ক নিয়েও কাজ করছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক।
কলকাতার মোট বায়ুদূষণের শতকরা কত ভাগ এই সব উৎসগুলি থেকে ছড়ায়?
সেই সম্পর্কিত নির্দিষ্ট তথ্য কিন্তু পরিবেশ দফতর বা রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের হাতে নেই। তবে পরিবেশ দফতরের এক কর্তা জানাচ্ছেন, দূষণের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য এই তথ্য নির্দিষ্ট ভাবে জানা প্রয়োজন। নিরি-কে দিয়ে সেই কাজও শুরু হয়েছে। তা শেষ হতে বছর দেড়েক লাগবে। যদিও পরিবেশকর্মীদের অনেকেই বলছেন, প্রায় এক যুগ আগেই এক বার এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক এমন সমীক্ষা করেছিল। তা ছাড়া, নির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও কোন কোন উৎস থেকে বেশি দূষণ ছড়ায়, তা-ও মোটামুটি জানেন পরিবেশকর্তারা। তা হলে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না কেন?
এ দিন মার্কিন কনস্যুলেট এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে দূষণ নিয়ে একটি রিপোর্টও প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, নির্মাণশিল্পের শ্রমিক এবং কর্তাদের দূষণ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। শহরে সবুজের পরিমাণও বাড়ানো প্রয়োজন। জঞ্জাল নষ্ট করার ব্যবস্থাতেও উন্নতি
করতে হবে।
কারখানার দূষণ নিয়েও কড়া অবস্থান নিতে হবে। রাজ্য পরিবেশ দফতরের একটি সূত্রের দাবি, নির্মাণের ক্ষেত্রে কী কী নিয়ম পালন করতে হবে তা নিয়ে নির্দেশিকা দেওয়া রয়েছে। কল-কারখানাগুলিতেও নিয়মিত নজরদারি চলে। তা সত্ত্বেও দূষণ রোখা যাচ্ছে না।