পুরনোর গন্ধে মেতে মাঠময় আনন্দমেলা

১৩৮২-এর বৈশাখ বা ১৯৭৫-এর এপ্রিলে আনন্দমেলা-র সেই প্রথম সংখ্যাটা বইমেলায় আনলেও সচরাচর বের করছেন না স্টল-মালিক।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০২:৩৫
Share:

ঐতিহ্য: বিকোচ্ছে আনন্দমেলার পুরনো সংখ্যা। —নিজস্ব চিত্র।

নো মলাটে সত্যজিৎ রায়ের আঁকা সোনার কেল্লা-র টাইটেলের রঙিন ছবি। সঙ্গে লেখা, ‘দারুণ একটা মজার খবর। তোমাদের আনন্দমেলা এখন থেকে মাসে মাসে বেরুবে গায়ে নানান রকম রং মেখে।’

Advertisement

১৩৮২-এর বৈশাখ বা ১৯৭৫-এর এপ্রিলে আনন্দমেলা-র সেই প্রথম সংখ্যাটা বইমেলায় আনলেও সচরাচর বের করছেন না স্টল-মালিক। সেটা পেতে ২০ হাজার টাকা খরচ করার লোকও না কি রয়েছেন এ শহরে।

আদি যুগের আনন্দমেলা-র এক-একটি সংখ্যা মেলায় বিকোচ্ছে কমবেশি ৩৫০ টাকায়। বাঁধানো মলাটে একসঙ্গে গোটা বছরের সব ক’টি সংখ্যা হাতে নিলেই বুড়ো-আধবুড়োদের বয়সও কমতির দিকে। করুণাময়ী বাসস্ট্যান্ডের দিকের গেটের কাছে বইমেলার ছোট স্টলটিতে ঢুকে দু’কুড়ির কোঠার সন্দীপ বিশ্বাসের দশাও তথৈবচ। দমদমের বাসিন্দা, আইটি পেশাদারের স্পষ্ট মনে আছে, সত্তরের দশকে আনন্দমেলা-র মাসিক থেকে পাক্ষিক হয়ে ওঠার দিনগুলো। ঠিক তার আগের পর্বের প্রতিটা সংখ্যা বাগিয়ে ঘরে তুলতে মরিয়া সন্দীপ। তিনি বলছিলেন, ‘‘টিনটিনের কমিকস থেকে দারুণ গল্প-কবিতা, চমৎকার ছবি, ধাঁধা, শব্দজব্দ, পিসি সরকারের কাছে ম্যাজিকশিক্ষা মিলিয়ে গোটা মাসটাই আনন্দমেলাকে কাছছাড়া করা যেত না। বার বার পড়তাম!’’

Advertisement

সেই আনন্দমেলাগুলোই ফের ফিরে পড়তে চান, বহু মাঝবয়সী। বইমেলার স্টলে কবেকার মলিন কাগজের অক্ষরগুলো ঘিরে টাইমমেশিনে ডুব দেওয়ার স্বাদ। ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘মনোজদের অদ্ভূত বাড়ি’ বা চুণী গোস্বামীর ফুটবল-জীবনের গল্প ‘খেলতে খেলতে’-র পাতা ওল্টাতে অনেকেই আবেগে ভাসছেন। স্টল-মালিক শুভাশিস ভট্টাচার্যের অভিজ্ঞতা, ‘‘বেশি পুরনোর থেকে ৭০-৮০র দশকের পত্রপত্রিকা, পুজো সংখ্যা বা কমিকসের জন্য আলাদা টান দেখছি।’’ হারানো সময়কে ঝালিয়ে নেওয়ার বইটি পেয়ে কেউ কেউ পরে স্টলে মিষ্টি নিয়েও ঢুকছেন। এখন যাঁরা মাঝবয়সী, ৪০-৫০ এর পক্ককেশ থেকে তিরিশের কোঠার ছেলেমেয়েরাও কয়েক দশকের পুরনো আনন্দমেলা, বা দেশ-এর কিছু সংখ্যার জন্য পাগল।

পুরনো দুষ্প্রাপ্য বই যা কেউ আর ছাপেন না তা বইমেলায় বরাবরই বিক্রি করেন কিছু প্রকাশক। তাঁদের স্টলে হানা দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটান কিছু মগ্ন পাঠক। সুবর্ণরেখা-র তুষার মজুমদার বলছিলেন, তাঁর বাবা ইন্দ্রনাথ মজুমদারের আমলে বনেদি বাড়ি ভাঙার দিনকালে কোথায় না কোথায় হানা দিয়ে বই সংগ্রহের মজাদার সব গল্প আছে।

কিছু বই আবার পুরাতত্ত্বের সামগ্রীর মর্যাদা পেয়ে যায়। এই বইমেলাতেই টমাস ড্যানিয়েলের ভারতের ছবির স্কেচসমেত ১৮৩৪ সালের জরাজীর্ণ ‘ওরিয়েন্টাল অ্যানুয়াল’ বিকিয়েছে এক লক্ষ টাকায়। এ কালে অনলাইন নিলামের সুবাদে অনেকেই পুরনো বিদেশি বইয়ের দাম নিয়ে রীতিমতো ওয়াকিবহাল। কেউ কেউ ভবিষ্যতের লগ্নির জন্যও পুরনো বই কিনে রাখেন।

সুবর্ণরেখা-য় বাংলা, ইংরেজি সাহিত্য-সমাজতত্ত্বের বই, সাগ্নিকে আর্টের বই আবার সবুজপত্রে কিছুটা কাছের অতীতের পত্রপত্রিকার দিকে ঝোঁক। আনন্দমেলা তো বটেই, সত্যজিৎ-উত্তমকুমারের জমানার সিনেমার পুস্তিকা, ইন্দ্রজাল কমিকস, অমর চিত্র কথা-র জন্যও সে-কালের দশ-বিশ গুণ দাম দিতে অনেকেই মুখিয়ে।

পুরনো চালের কলেবর বৃদ্ধির মতোই, স্মৃতির সুরভিও যে দিনে-দিনে মধুর হয়ে ওঠে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন