বিপজ্জনক: এমনই ভাঙাচোরা হাল ওই আবাসনের। নিজস্ব চিত্র
বিপজ্জনক বাড়ি ভেঙে কলকাতা পুর-এলাকায় দুর্ঘটনা নতুন কিছু নয়। এ ধরনের দুর্ঘটনা আটকাতে পুরসভার বিপজ্জনক বাড়ি-সংক্রান্ত নতুন আইনও তৈরি হয়েছে।
কিন্তু ব্রুকলিন শ্রমিক আবাসনের তাতে কিছু আসে-যায়নি। আবাসন এবং সেখানকার বাসিন্দারা যে তিমিরে ছিলেন, সেখানেই রয়েছেন।
সুকুমার রায়ের ‘বুড়ির বাড়ি’র সঙ্গে আবাসনটির কার্যত কোনও ফারাক নেই। বুড়ির বাড়িতে ভর দিতে ভয় করত, খকখক কাশি হলে সেই ঘর ঠকঠক করে নড়ত। ব্রুকলিন আবাসনের বাইরে দিয়ে সশব্দে গাড়ি গেলে বা জোরে শব্দ হলে ইঁট-পলেস্তারা খসে পড়ে, বারান্দা বা দরজা-জানালা হামেশাই ভেঙে যায়!
খিদিরপুর ডকের কাছে কলকাতা পুরসভার ৮০ নম্বর ওয়ার্ডে বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা খণ্ডহর-সদৃশ এই ব্রুকলিন আবাসনের কোয়ার্টার্সগুলিতে প্রায় তিন হাজার মানুষ বেআইনি ভাবে বসবাস করছেন। গোটাটাই জবরদখল করে থাকা। যে কোনও সময়েই যে হুড়মুড় করে এই কোয়ার্টার্স ভেঙে পড়তে পারে, তা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারাও জানেন। তবু আবাসনের বাইরে ‘বিপজ্জনক বাড়ি’র বোর্ড বসে না। বাসিন্দাদের সরানোর চেষ্টাও কোনও তরফে নেই বলেই অভিযোগ। তেমন কোনও পরিকল্পনা হলে উল্টে স্থানীয় নেতারাই তা ভেস্তে দেন। আরও অভিযোগ, বাসিন্দাদের বদলে স্থানীয় কিছু ক্ষমতাশালী নেতা-নেত্রী টাকা নিয়ে গরিব পরিবারগুলিকে থাকার জায়গা করে দিচ্ছেন। পাশাপাশি, হুকিংয়ের মাধ্যমে কোয়ার্টার্সগুলিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করেও এলাকার কিছু লোক বাসিন্দাদের থেকে মাসিক টাকা তোলেন বলেও অভিযোগ।
আবাসনে গিয়ে দেখা গেল, থিকথিকে আবর্জনায় ভরা পূতিগন্ধময় মাঠের ভিতরে মাথা তুলে কোনওমতে দাঁড়িয়ে পুরনো-ঝুরঝুরে চারতলা-পাঁচতলা কোয়ার্টার্স। বাড়িগুলির বেশির ভাগ অংশ ঝুলে পড়েছে, খসে গিয়েছে, বড়-বড় গাছ গজিয়েছে সেখানে। তারই মধ্যে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে দেড় হাজারের বেশি পরিবার।
কলকাতা পুরসভার নতুন আইন বলছে, বিপজ্জনক বাড়ির মালিককে দ্রুত আবাসিকদের সরিয়ে বাড়ি সারানোর ব্যবস্থা করতে হবে। পুরসভা এক বার ওই বাড়ি ‘কনডেম্ড’ বা বসবাসের অযোগ্য বলে ঘোষণা করার পরেও যদি তা মালিক না সারান, তা হলে দরপত্র ডেকে নির্দিষ্ট এজেন্সিকে দিয়ে বাড়ি সারানো হবে। তা হলে পরিস্থিতি জানা সত্ত্বেও ব্রুকলিনের ক্ষেত্রে তা করা হচ্ছে না কেন? কেন কয়েক হাজার মানুষের প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে? দুর্ঘটনা ঘটলে পুরসভা তার দায় নেবে তো?
ব্রুকলিন আবাসন আসলে কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের সম্পত্তি। জমিও তাদের। পোর্ট সূত্রের খবর, একাধিক বার তারা জবরদখলকারীদের সরানোর অভিযোন চালাতে চেয়েছেন। কিন্তু স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতার প্রবল বাধায় তা হয়ে ওঠেনি। এলাকার তৃণমূল নেত্রী সুলতানা বেগমের কথায়, ‘‘পোর্ট অনেক বার তুলতে এসেছে। কিন্তু ববিদা (ফিরহাদ হাকিম) ওঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন বলে তুলতে পারেনি। গরিব মানুষগুলো কোথায় যাবে বলুন তো?’’
এলাকার বিধায়ক তথা নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের বক্তব্য, ‘‘আমরা পোর্টকে বারবার বলছি ওই জমিটা দিয়ে দিতে। তা হলে ‘বাংলার বাড়ি’ প্রকল্পে গরিব মানুষগুলোর জন্য আমরা ফ্ল্যাট বানিয়ে দিতাম। ওরা কিছুতেই জমি দিচ্ছে না। এত পরিবারকে তো আর ঘাড় ধাক্কা দিয়ে পথে বার করা যায় না। ফলে সমস্যায় পড়েছি।’’ এখনও টাকার বিনিময়ে ওই বিপজ্জনক আবাসনে লোক ঢোকানো এবং হুকিংয়ের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে টাকা লুঠের ব্যাপারে স্থানীয় কাউন্সিলর আনোয়ার খানের বক্তব্য, ‘‘না না, আগে এক জন টাকা তুলতেন। ওঁকে আমরা পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছি। ব্লক মিটারে বিদ্যুৎ নিয়ে কিছু লোক তা আবাসনে সরবরাহ করে টাকা তুলছেন বলে শুনেছি। ওই বিষয়টি দেখছি।’’