আবাসনে ঢুকে তাণ্ডব, চুরমার ৭৪টি গাড়ি

সাতসকালে আবাসনে হাজির ষন্ডাগুন্ডা চেহারার শ’দেড়েক যুবক। হাতে ইঁট, লোহার রড। আবাসন চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা একের পর এক গাড়ি ভাঙচুর করল তারা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পার্কিংয়ে থাকা ৭৮টি গাড়ি। রেহাই পায়নি ছোটদের সাইকেল, নিরাপত্তারক্ষীদের ঘরও।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

পণ্ডিতিয়া শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:২৮
Share:

ভাঙচুরের পরে।

সাতসকালে আবাসনে হাজির ষন্ডাগুন্ডা চেহারার শ’দেড়েক যুবক। হাতে ইঁট, লোহার রড। আবাসন চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা একের পর এক গাড়ি ভাঙচুর করল তারা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পার্কিংয়ে থাকা ৭৮টি গাড়ি। রেহাই পায়নি ছোটদের সাইকেল, নিরাপত্তারক্ষীদের ঘরও। কেটে দেওয়া হয়েছিল ফোনের লাইন। এমনকী, কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদের স্টিকার সাঁটা কিংবা অর্থ মন্ত্রকের বোর্ড সাঁটা, নীল বাতি লাগানো গাড়িকেও রেয়াত করেনি হামলাকারীরা। রবিবার সকালে টানা চল্লিশ মিনিট তাণ্ডব চালানোর পরে নিশ্চিন্তে আবাসন ছেড়ে বেরিয়েও যেতে পেরেছে তারা।

Advertisement

ঘটনাস্থল দক্ষিণ কলকাতার পণ্ডিতিয়া রোড। সাতসকালে এমন হামলা দেখে কার্যত ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিলেন ‘ফোর্ট ওয়েসিস’ নামে ওই আবাসনের বাসিন্দারা। দুপুরে আবাসন চত্বরে দাঁড়িয়ে হামলার বিবরণ দিতে গিয়ে আয়কর দফতরের কমিশনার নীরজ সিংহের মন্তব্য, ‘‘এই ঘটনা জঙ্গলের রাজত্বকেও হার মানাবে!’’ নীরজ আদতে বিহারের বাসিন্দা। ওই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার অবনতি নিয়ে নানা সময়েই কটূক্তি সইতে হয়েছে তাঁকে। এ দিন নীরজের দাবি, বিহারেও বোধ হয় এমনটা হয় না।

হামলার পরে পুলিশের বিরুদ্ধেও এ দিন নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলেছেন বাসিন্দারা। অভিযোগ, হামলার সময়ে লেক থানায় খবর দেওয়া হয়েছিল। পুলিশ এলেও আক্রমণকারীদের বাধা দেওয়া হয়নি। পুলিশের সামনে দিয়েই পালিয়েছে তারা। হামলার পরেও তেমন সক্রিয় হয়নি পুলিশ। রাতের দিকে অবশ্য চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে হাঙ্গামা, ভাঙচুরের মামলা দায়ের হয়েছে বলে জানায় পুলিশ। সব দেখে অনেকেরই বক্তব্য, বিভিন্ন এলাকায় এই ধরনের তাণ্ডব করার সাহস যারা পায়, বহু ক্ষেত্রেই তাদের মাথায় থাকে কোনও না কোনও রাজনৈতিক ছাতা। সর্বদাই শাসক দলের সঙ্গে এই ধরনের লোকজনের ঘনিষ্ঠতার অভিযোগও শোনা যায় বেশি।

Advertisement

ভাঙচুরের পরে।

এ দিন পণ্ডিতিয়ার তাণ্ডব কী নিয়ে? পুলিশ জানায়, শনিবার রাত আড়াইটে নাগাদ হাজরা রোড দিয়ে যাওয়ার সময়ে একটি মার্সিডিজ গাড়ি একটি স্কুটিতে ধাক্কা মারলে স্কুটির চালক-সহ তিন জন ছিটকে পড়েন। আহতদের হাসপাতালে নিয়ে গেলে অভিজিৎ পাণ্ডে (২৪) নামে এক জনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। বাকি দু’জন পিজি-তে ভর্তি।

পুলিশ সূত্রের দাবি, দুর্ঘটনার পরেই ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ১০০ মিটার দূরে গাড়িটি ফেলে চম্পট দেন চালক ও আরোহীরা। সকালে গা়ড়িটির ভিতরে ওই আবাসনের নাম লেখা কাগজ মেলে। তা নিয়ে জনা দশেক যুবক সকাল পৌনে আটটা নাগাদ আবাসনে হাজির হয়ে ওই কাগজ দেখিয়ে গাড়ির মালিক সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে। রক্ষীরা আমল না দেওয়ায় ফিরে গিয়ে শ’দেড়েক যুবক এসে হামলা শুরু করে।

নীরজ জানান, এ দিন সকালে তাঁর মেয়ে আবাসন থেকে বেরোচ্ছিলেন। তখনই তাণ্ডব শুরু হয়। তা দেখে তাঁর মেয়ে কোনও মতে পালান। মেয়ের চিৎকার শুনেই ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে ঘটনাটি দেখেন তিনি। দুপুরে তাঁর মন্তব্য, ‘‘আমি এখন মুম্বইয়ে থাকি। আজকের ঘটনার পরে স্ত্রী, কলেজপডুয়া মেয়ে ও স্কুলপড়ুয়া ছেলেকে কলকাতায় রাখতেই ভয় করছে।’’

দুপুরে আবাসন চত্বরে গিয়ে দেখা গেল, যেন ঝড় বয়ে গিয়েছে সেখানে। নামী-দামি দেশি, বিদেশি ব্র্যান্ডের গাড়িগুলি দুমড়ে গিয়েছে। কোনওটির উইন্ডস্ক্রিন ভাঙা, কোনটির জানলা নেই, কোনও গাড়ির আবার পিছনের কাচ ভেঙে পড়েছে। রিসেপশনের কাচের দরজা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে তা ছড়িয়ে পড়েছে। ভাঙা গাড়িগুলির মধ্যে একটি ‘কেএমসি-এমআইসি’ স্টিকার সাঁটা একটি এসইউভিও দাঁড়িয়েছিল।

বাসিন্দারা জানান, ওই আবাসনেই কলকাতার মেয়র পারিষদ (উদ্যান) দেবাশিস কুমারের এক আত্মীয়া থাকেন। ঘটনার কথা শুনে ওই আবাসনে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দেবাশিসবাবুর দাবি, গাড়িটি তাঁর নয়। ‘এম আই সি’ লেখা স্টিকার সাঁটা সেই গাড়ি তাঁর এক পরিচিতের। মেয়র পারিষদের আরও বক্তব্য, গত সন্ধ্যায় তাঁর নিজের গাড়ি খারাপ হয়ে গেলে, ওই পরিচিতের থেকে গাড়িটি নিয়েছিলেন দেবাশিসবাবু। তাই বলে অন্যের গাড়িতে থাকবে ‘এম আই সি’-র স্টিকারও? দেবাশিসবাবুর নির্লিপ্ত জবাব, ‘‘এমন তো হতেই পারে!’’ কিন্তু প্রশ্ন উঠছে আরও। দেবাশিসবাবু একাধারে ওই এলাকার কাউন্সিলর তথা মেয়র পারিষদ। তাঁরই এলাকায় এমন ভাবে সরকারি স্টিকার যদি বেআইনি ভাবে অন্য কেউ ব্যবহার করেন, তার কি সে দিকে নজর দেওয়ার কথা নয়? এর কোনও সদুত্তর মেলেনি।

দুর্ঘটনা ঘটায় এই গাড়িটিই। রবিবার। — নিজস্ব চিত্র

বিকেলে হামলা নিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করেন আবাসিক কমিটির সদস্যরা। অভিযোগ, দু’কিলোমিটারের মধ্যেই থানা, তবু পুলিশ আসতে দেরি করেছে। পুলিশ তাড়াতাড়ি এলে হামলা ঠেকানো যেত। কমিটির সভাপতি অজিত দাগা বলেন, ‘‘আমরা আতঙ্কিত। পুলিশ নিরাপত্তা দিক।’’ যদিও অভিযোগ অস্বীকার করে কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) সুপ্রতিম সরকার বলেন, ‘‘পুলিশ যাবতীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। আবাসিকদের অভিযোগ-সহ সব কিছু খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’ শনিবার রাতের অভিযুক্ত গাড়িচালককে গ্রেফতারের দাবিতে অভিজিতের মৃতদেহ নিয়ে হাজরা মোড়ে বিক্ষোভ দেখান তাঁর পাড়ার বাসিন্দারাও। প্রায় আধ ঘণ্টা পথ অবরোধ করেন। পথ অবরোধের জেরে যানজটেরও সৃষ্টি হয়। পরে পুলিশ এসে অবরোধকারীদের হঠিয়ে দেয়।

যেই গাড়ি ঘিরে এই হামলা, তার হদিস কি মিলল? গাড়িটি কি আবাসনের কারও? দেবাশিসবাবুর বক্তব্য, গাড়িটি কোনও আবাসিকের নয়। তবে গাড়িটি যে আবাসনে ঢুকেছিল, তা জানা গিয়েছে আবাসনের রেজিস্টার থেকে। গাড়িটি কোনও সংস্থার নামে নথিভুক্ত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন