থালা ভরা আন্তরিকতার পার্সি আহার

কথাটা যে ভুল নয়, পড়ন্ত বিকেলে মেহের হানসোটিয়ার সঙ্গে কথায় তা প্রমাণ হল। গল্পের মাঝে কানে আসছিল আজানের সুর। ঠিক সামনে তখন অনির্বাণ ‘পবিত্র আগুন’।

Advertisement

জয়তী রাহা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:৩৭
Share:

ধর্মশালার সেই আহারকক্ষ। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

চাঁদনি চক মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে অলিগলির মোচড়ে সোজা পৌঁছে যাওয়া যায় বো ব্যারাকের সামনে। বড়দিনের সাজানো বো ব্যারাক নয়, এ হল আটপৌরে বো স্ট্রিট। খড়খড়ি জানালার তিনতলা লাল বাড়িগুলির খোলা গ্রিলে থরে থরে ঝোলানো কায়দার জামা কাপড় মেলে মালিক তত ক্ষণে নিশ্চিন্তপুরে। মনে হতেই পারে, এ যেন ইতিহাসে পড়া হিউ এন সাং-এর রাজত্বকাল, যেখানে দরজা খোলা থাকলেও চুরির ভয় ছিল না বলে শোনা যায়। হাসলেন পাশের পথচারী — আমাদের এখানে এমনই। শান্তি আর স্বাধীনতা, এর বাইরে বিশেষ কিছু নেই। ডান দিকের রাস্তায় পাবেন বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভা, বাঁ দিকে মানেকজি রুস্তমজি পার্সি ধর্মশালা। এ তল্লাটে বাইবেল আর কোরানের সুর মিলেমিশে হয় নতুন সুর।

Advertisement

কথাটা যে ভুল নয়, পড়ন্ত বিকেলে মেহের হানসোটিয়ার সঙ্গে কথায় তা প্রমাণ হল। গল্পের মাঝে কানে আসছিল আজানের সুর। ঠিক সামনে তখন অনির্বাণ ‘পবিত্র আগুন’। মানেকজি রুস্তমজি পার্সি ধর্মশালার আবাসিক ম্যানেজার মেহের। আদতে মুম্বইয়ের মেয়ের বিয়ে হয়েছিল গুজরাতের বাসিন্দা দারা হানসোটিয়ার সঙ্গে। ষাটোর্ধ্ব পার্সি দম্পতি প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর ধরে কলকাতার বাসিন্দা। ১১০ বছরের পুরনো ধর্মশালার রান্নাঘর সামলাচ্ছেন ওঁরা। ধর্মশালাটি শুধু পার্সিদের জন্য হলেও ওঁদের রান্নাঘরে স্বাগত সবাই।

ঊনবিংশ শতকের কলকাতায় প্রায় এক লক্ষ পার্সির বাস ছিল। যাদের অনেকেই ছিলেন শিল্পপতি-ব্যবসায়ী। সামাজিক দায়িত্ব পালনে পার্সিরা বরাবর অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। শহরের ইতিহাসে ছড়িয়ে রয়েছে তারই নানা দৃষ্টান্ত। নিজেদের অস্তিত্ব সম্পর্কে উদাসীন, শান্তিপ্রিয়, হাসিখুশি এবং আন্তরিক পার্সিদের এই শহরে সংখ্যাটা এখন সত্যিই তলানিতে। মেরেকেটে ৪০০ জনের বাস। যাঁদের অধিকাংশই একা থাকা বয়স্ক। ওঁদের দেখভালের দায়িত্ব অবশ্য পার্সি ট্রাস্টের। দেড়শো বছরেরও বেশি আগে এজ়রা স্ট্রিটের আদি অগ্নি মন্দিরে বসে তিন পার্সি ব্যবসায়ী, মানেকজি রুস্তমজি, নওরোজি পেন্টনজি এবং কাওয়াসজি পেন্টনজি তৈরি করেছিলেন এই ট্রাস্ট। পার্সি বয়স্কদের পাশাপাশি ট্রাস্টই দেখভাল করে এ শহরে পার্সিদের যাবতীয় সম্পত্তির।

Advertisement

মানেকজি রুস্তমজির মৃত্যুর পরে ১৯০৯ সালে কলকাতা, মুম্বই এবং চিনে ছড়িয়ে থাকা তাঁর বন্ধুরা মিলে ৯, বো স্ট্রিটে তৈরি করে ফেলেন তাঁর নামাঙ্কিত তিনতলা এই পার্সি ধর্মশালা। এ শহরে বেড়াতে বা কাজে আসা পার্সিদের থাকার জন্য এই ব্যবস্থা। তথ্য বলছে, সেই সময়ে ঘর প্রতি ভাড়া ছিল আট আনা। তিন বেলা খাবারের খরচ ছিল দু’টাকা। যে কোনও কারণেই হোক সেই বাড়িটি ভেঙে ১৯৩৬ সালে তৈরি হয়েছিল এই দোতলা ধর্মশালা ভবন। তখন ঘর ভাড়া বেড়ে হয় ১২ আনা। তিন বেলা খাবারের খরচ সাড়ে তিন টাকা।

খাদ্য রসিক বাঙালির কাছে গত কয়েক বছর ধরে বাড়তি পাওনা হয়েছে শহরের পার্সি খাদ্য সম্ভার। কলকাতার একমাত্র পার্সি রেস্তরাঁটি কিড স্ট্রিটে। তবে পার্সিরাই বলেন, সে রেস্তরাঁর মালকিন বাঙালি মেয়েটি পার্সি বধূ হওয়ায় কিছু রান্নায় ফিউশন ঘটেছে। কিন্তু মেহেরের রান্নাঘর নিখাদ পার্সি। তবে মেহেরের রান্নার স্বাদ পেতে ২৪ ঘণ্টা আগে ফোনে জানিয়ে দিতে হবে সকালের জলখাবার (৮টা—৯-৩০টা), দুপুর (১২-৩০টা—১-৩০টা) কিংবা রাতে (৭-৩০টা—৯টা) আপনি কী খেতে চাইছেন এবং ক’জন যাচ্ছেন। কারণ, বাসি খাবার বা খাবার নষ্ট করার ঘোর বিরোধী দারা ও মেহের। সকাল ছ’টা থেকে শুরু হয়ে যায় ওঁদের রান্না। নিউ মার্কেট থেকে নিজে বাজার করে আনেন দারা। সাহায্যের জন্য রয়েছেন স্থানীয় যুবক আলি। তবে পার্সি রান্নাঘরের গর্ব, চিকেন/মটন ধানসাক, সালি চিকেন/মটন, মেহের স্পেশ্যাল পোলাও ডাল, পত্রানি মচ্ছি, এগ চাটনি প্যাটিস, চিকেন ফর্চা বা লগান নু কাস্টার্ডের মতো হরেক লোভনীয় পদের রহস্যের চাবিটা থাকে হানসোটিয়া দম্পতির হাতে। ডালের মধ্যে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি চিকেন/মটন দিয়ে রান্না ধানসাক এক সময়ে পার্সিদের অন্ত্যেষ্টিতে পরিবেশন করা হত। বাদামি ভাত এবং স্যালাডের সঙ্গে পরিবেশিত ধানসাক এখন সব সময়ের জন্য জনপ্রিয়। মুম্বই থেকে ডাকযোগে আসা এই রান্নাঘরের যাবতীয় মশলা।

প্রতিদিন বেশ কয়েক জন পার্সি বয়স্কদের জন্য খাবার যায় এই হেঁশেল থেকেই। দেড়শো জনের মতো নিমন্ত্রিতকে নিয়ে পার্টির ব্যবস্থাও হয়ে যায় এখানে। আলি, ডেভিসদের নিয়ে হাতে হাত লাগিয়ে সে সবের ব্যবস্থা করে দেন ওঁরা।

ছিমছাম ছোট্ট এই আয়োজনে ঝাঁ চকচকে রোশনাই বা ছুরি-কাঁটার ঠুংঠাং শুনবেন না। শুধুই আন্তরিকতা ভরা আপ্যায়নের মাঝে হাজির হবে ডিশ ভরা পার্সি আহার। সামনে তাকালেই সেই ঘড়ি, ‘ম্যানেকজি রুস্তমজি পার্সি ধর্মশালা, ১৯৩৬’ আজও ছুটছে সে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement