ভরদুপুরে কলিং বেল বাজতে দরজা খুলেছিলেন গৃহকর্ত্রী। দেখেন, সামনে দাঁড়িয়ে অপরিচিত তিন যুবক, এক জনের হাতে হাতুড়ি, বাকিদের হাতে ধারালো ছুরি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই হাতুড়ি দিয়ে ওই প্রৌঢ়ার মাথায় আঘাত করল এক যুবক। অপরিচিতেরা জোর করে বাড়িতে ঢুকতে চাইছে দেখে চেঁচিয়ে উঠতেই হাতুড়ি বসিয়ে দেওয়া হল বাড়ির পরিচারিকার ডান হাতেও। দুই মহিলার চিৎকারে প্রতিবেশীরা জড়ো হয়ে যাওয়ায় ধরা অবশ্য পড়ে যায় এক জন। বাকি দুই যুবক পালিয়ে যায়।
মঙ্গলবার পার্ক স্ট্রিটের অভিজাত আবাসনে এই ঘটনায় ফের প্রশ্ন উঠেছে ফ্ল্যাটের নিরাপত্তা নিয়ে। রবিবারই অভিনেত্রী রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে চুরির ঘটনাতেও ফ্ল্যাটের বিকল সিসিটিভি-সহ নিরাপত্তার ঢিলেঢালা হাল নিয়ে অভিযোগ উঠেছিল। এ দিনের ঘটনাতেও অভিযোগ ওই আবাসনের দোতলায় একটি ফ্ল্যাটে চলা এক গেস্ট হাউস নিয়ে, যার জেরে হামেশাই অপরিচিত লোকেদের যাতায়াত লেগে থাকে সেখানে।
এ দিনের ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন আবাসনের বাকি বাসিন্দারা। এ দিন ওই অপরিচিত যুবকদের নিরাপত্তারক্ষীরা কেন বাধা দেননি, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাঁরা। যেখানে পরিবার নিয়ে লোকজন বসবাস করেন, সেখানে একটি ফ্ল্যাটে কী করে গেস্ট হাউস চলছে, সে প্রশ্নও ওঠে।
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানিয়েছে, ওই আবাসনে নিযুক্ত নিরাপত্তারক্ষীদের বক্তব্য, আবাসনের দোতলায় ওই গেস্ট হাউসে প্রায়ই অনেকে আসেন। এ দিনও ওই তিন যুবক এসে জানায়, গেস্ট হাউস বুক করতে যেতে চায় তারা। তাই তাদের বাধা দেওয়া হয়নি। সেই সুযোগেই ওই তিন জন দোতলার বদলে তিন তলায় পৌঁছয় সরাসরি।
পুলিশ সূত্রের খবর, ৬১বি পার্ক স্ট্রিটের ওই ছ’তলার আবাসনে তিনতলার ফ্ল্যাটে পরিচারিকা অনিতা তাঁতিকে নিয়ে থাকেন ৬৭ বছরের ওই প্রৌঢ়া রাজ জৈন। তাঁর ছেলে শিবকুমার জৈন সপরিবার ওই আবাসনেই চারতলায় থাকেন। এ দিন দুপুরে এই শিবকুমার ও তাঁর স্ত্রী ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে গিয়েছিলেন। সেই সময়েই বাড়িতে উপস্থিত হয় ওই দুষ্কৃতীরা। হাতুড়ির আঘাতে জখম হন রাজদেবী ও অনিতা।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, দুই মহিলার চিৎকারে আবাসনের লিফ্টম্যান অশোক পাত্র ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। তাঁকেও দুষ্কৃতীরা ছুরি দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করলে সেটি তাঁর গা ঘেঁষে বেরিয়ে যায়। সকলের চিৎকারে আবাসনের অন্য বাসিন্দারা ছুটে আসেন। সেই সময়ে দু’জন পালাতে পারলেও মহম্মদ ইমতিয়াজ নামে এক যুবককে ধরে ফেলে মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দেন তাঁরা। পুলিশ জানায়, মধ্য কলকাতার বাসিন্দা ইমতিয়াজের বিরুদ্ধে একাধিক দুষ্কর্মের অভিযোগ রয়েছে।
এ দিনের হামলার সময়েই বাড়ি পৌঁছন রাজদেবীর ছেলে শিবকুমার। তিনি বলেন, ‘‘বাড়িতে ঢোকার সময়ে মায়ের চিৎকার শুনে তাড়াতাড়ি উপরে উঠে দেখি এই কাণ্ড। প্রতিবেশীরা চলে এসেছিলেন, তাই এক জনকে অন্তত ধরতে পেরেছি।’’
শিবকুমারবাবুর অভিযোগ, ‘‘গেস্ট হাউসের কারণে আবাসিকদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার কথা আগেও ওই গেস্ট হাউসের মালিককে বলা হয়েছে। তিনি কোনও রকম গা করেননি। তাই যে-কেউ যখন খুশি ওখানে ঢুকতে পারেন।’’ ঘটনার পরে আবাসনে থাকা সমস্ত সিসিটিভির ফুটেজ খতিয়ে দেখছে পুলিশ। রাজদেবীকে পার্কস্ট্রিটেরই একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে পার্ক স্ট্রিট থানার পুলিশ। তবে পার্ক স্ট্রিটের ওই জায়গায় এমন ঘটনা আগে না ঘটায়, কী কারণে এ দিনের ওই আক্রমণ, তা স্পষ্ট নয় পুলিশের কাছে। ওই যুবকেরা ডাকাতির উদ্দেশ্যেই এসেছিল বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করছে পুলিশ। তবে ইমতিয়াজকে জেরা করে পুলিশ জানতে পেরেছে, তিন বছর আগে মানসিক অসুস্থতার কারণে জোকায় একটি হোমে ছিল সে। সেখান থেকে সুস্থ হয়ে গুজরাতে চলে যায়। এর পরে কবে সে কলকাতায় ফেরে বা আপাতত কোথায় থাকত, তা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। কলকাতা পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা জানান, জেরায় ইমতিয়াজ জানিয়েছে প্রতিশোধ নিতেই সে এই কাজ করে। তবে তার কথা আদৌ সত্যি কি না, খতিয়ে দেখছে পুলিশ। পাশাপাশি, ইমতিয়াজের সঙ্গে বাকি দু’জন কারা ছিল তা-ও তদন্ত করে দেখছে পুলিশ।