অটিজ়ম সঙ্গে নিয়েই নজরে এ বার উচ্চশিক্ষা

সল্টলেক স্কুল থেকে দশম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষায় সে উত্তীর্ণ হয়েছে ৯৩.৬ শতাংশ নম্বর নিয়ে।

Advertisement

সুচন্দ্রা ঘটক

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৯ ০২:১৬
Share:

পড়াশোনার পাশাপাশি সিন্থেসাইজার বাজানোয় আগ্রহ রয়েছে ময়ূখের। নিজস্ব চিত্র

ছেলে অটিস্টিক। অনেকেই বলেছিলেন, সাধারণ স্কুলে গেলে পিছিয়ে পড়বে। হাল ছাড়েননি বাবা-মা। সকলের মধ্যেই বড় করতে চেয়েছিলেন ছেলেকে। সেই ছেলে, ময়ূখ মিত্রের আইসিএসই-র ফল প্রকাশ হয়েছে মঙ্গলবার। সল্টলেক স্কুল থেকে দশম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষায় সে উত্তীর্ণ হয়েছে ৯৩.৬ শতাংশ নম্বর নিয়ে। কম্পিউটার সায়েন্সে পেয়েছে একশোয় একশো। শুভেচ্ছাবার্তা পেলেই সে জানাচ্ছে, আগামী দিনে আরও অনেক ভাল করার স্বপ্ন দেখছে।

Advertisement

যাত্রাটা সহজ ছিল না। বাধা এসেছে নানা ক্ষেত্রেই। তবে বুধবার লেকটাউন এলাকার বাড়িতে বসে ময়ূখের মা অনিন্দিতা মিত্র জানালেন, চারপাশে সকলের সাহায্য না পেলে তাঁর ছেলের পক্ষে এত দূর আসা সম্ভব হত না। ছেলের বয়স যখন বছর তিনেক, তখন প্রথম তাঁরা খেয়াল করেন, কোথাও সমস্যা হচ্ছে। সমবয়সি শিশুদের মতো আচরণ নয় তাঁর ছেলের। সমস্যাটা বুঝতে কেটে গিয়েছে আরও অনেকটা সময়। এক মনোরোগ চিকিৎসক থেকে আর এক চিকিৎসকের কাছে ঘুরে ধীরে ধীরে বোঝা যায়, শিশুটির কথা বলা ও মিশতে অসুবিধা হওয়ার কারণ। বাবা মানস মিত্র আর মা অনিন্দিতা এরই মধ্যে খেয়াল করেন, আপাত ভাবে চঞ্চল ছেলের বেশ মনোযোগ রয়েছে বিশেষ কিছু দিকে। যেমন কোন বছরে কোন তারিখ, কোন দিন পড়েছিল, ক্যালেন্ডার না দেখেই দিব্যি বলে দিতে পারত সে। ইংরেজি ভাষাচর্চা এবং কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়েও ছিল প্রবল টান। স্কুলে বা সমাজে মেলামেশার ক্ষেত্রে যে কিছুই সমস্যা হত না, তা নয়। সব সময়েই কম কথার মানুষ ময়ূখ। তাই বেশি বন্ধুও হয়নি। তবে স্কুলের কয়েক জন শিক্ষক এবং গৃহশিক্ষকদের কাছে সাহায্য পেয়ে আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে। অনিন্দিতা বলেন, ‘‘সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে এখনও খুব টেনশন হয় ওর। তবে আগের চেয়ে ওর অস্থিরতা কিছুটা কমেছে।’’

আপাতত অবশ্য সে সব ভাবনায় মন যাচ্ছে না ময়ূখের। ইতিমধ্যেই পিয়োর সায়েন্স নিয়ে একাদশ শ্রেণির পড়াশোনা শুরু করে দিয়েছে। ভর্তি হয়েছে নতুন স্কুলে। ইচ্ছে, বড় হয়ে বায়ো-কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়াশোনা করবে। সঙ্গে মন দিয়েছে সিন্থেসাইজ়ার বাজানোর শিক্ষাতেও। সঙ্গীত তার খুবই পছন্দের। সময় পেলেই বলিউডের গান শোনে ময়ূখ। মাঝেমধ্যে সিনেমা দেখতেও ভাল লাগে। এ দিন সে বলছিল, ‘‘পুরনো স্কুলের কথা মাঝেমাঝেই মনে পড়ছে। তবে নতুন স্কুলে পড়াশোনা করতে ভালই লাগছে।’’

Advertisement

সল্টলেক স্কুলের প্রিন্সিপাল সুগতা ডিসুজা এ দিন জানান, শিক্ষকেরা সকলেই ময়ূখের বিশেষ যত্ন নিতেন। আইসিএসই-র আগেও স্কুলের তরফে কাউন্সিলের কাছে আবেদন পাঠানো হয়, যাতে ময়ূখকে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পড়ুয়াদের প্রাপ্য বাড়তি আধ ঘণ্টা লেখার জন্য দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের আশা, ময়ূখ খুব ভাল করবে আগামী দিনেও।’’

দিন কয়েক আগে সিবিএসই-র দশম শ্রেণির পরীক্ষাতেও ৯২ শতাংশ নম্বর নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে ডিপিএস রুবি পার্কের আর এক অটিস্টিক ছাত্র কৃতীমান দাশগুপ্ত। ময়ূখ ও কৃতীমানের এই সাফল্য বহু বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও তাদের অভিভাবককে ভরসা জোগাবে বলে মনে করছেন মনোরোগ চিকিৎসক ও স্পেশ্যাল এডুকেটরেরা। স্পেশ্যাল এডুকেটর লিপিকা ভট্টাচার্য যেমন জানান, অটিস্টিক শিশুদের আচরণ সব সময়ে চেনা ছকের মধ্যে পড়ে না। ওদের নিজস্ব একটা বৌদ্ধিক ছক থাকে। কোন শিশুর বুদ্ধি কী ভাবে কাজ করছে, তা এক বার ধরে ফেলা গেলেই তাকে অনেক কিছু শেখানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। সন্তান বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন হলে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক সময়েই চিন্তিত হয়ে পড়েন অভিভাবকেরা। কিন্তু মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব মনে করেন, ময়ূখের সাফল্য প্রমাণ করল অটিস্টিক হওয়া মানেই সর্ব ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া নয়। তিনি বলেন, ‘‘অটিজ়ম অধিকাংশ সময়েই সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। নিজের ভাবনা বোঝানো এবং অন্যেরটা বুঝতে অসুবিধে হয়। তার মানে এটা কখনওই নয় যে, সেই মানুষটি কিছুই শিখতে পারে না। কিংবা পড়াশোনা করতে পারে না। সেটাই আবার প্রমাণিত হল।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন