Bankfraud

কলকাতায় বসে ইংল্যান্ডে ব্যাঙ্ক জালিয়াতি! শহরেই ‘মিনি জামতাড়া’

ভারতের একটি প্রথম সারির বেসরকারি ব্যাঙ্কের ইংল্যান্ডের একটি শাখায় গিয়ে এক গ্রাহক ব্যাঙ্ক জালিয়াতির অভিযোগ জানান।

Advertisement

সিজার মণ্ডল

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০২০ ১৮:২৫
Share:

—প্রতীকী ছবি।

বিলেতের একটি ব্যাঙ্ক জালিয়াতির তদন্তে এ বার উঠে এল কলকাতার যোগ। আর সেই সঙ্গে জানা গেল এই শহরেই গজিয়ে উঠেছে ‘মিনি জামতাড়া।’ গোটা চক্রের হদিশ না পাওয়া গেলেও, আন্তর্জাতিক জালিয়াতি চক্রের কয়েক জন পান্ডার প্রাথমিক হাল-হদিশ পেয়েছেন গোয়েন্দারা। তাঁদের সন্দেহ হিমশৈলের চূড়াটুকু দেখা যাচ্ছে।

Advertisement

ঘটনার সূত্রপাত এ বছরের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে। ভারতের একটি প্রথম সারির বেসরকারি ব্যাঙ্কের ইংল্যান্ডের একটি শাখায় গিয়ে এক গ্রাহক ব্যাঙ্ক জালিয়াতির অভিযোগ জানান। জন্মসূত্রে ভারতীয় কিন্তু ইংল্যান্ডের নাগরিক ওই গ্রাহকের অভিযোগ, তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে ভারতীয় অর্থমূল্যে প্রায় ৮৭ লাখ টাকা গায়েব হয়ে গিয়েছে। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ প্রাথমিক তদন্ত করতে গিয়ে দেখেন, ওই গ্রাহকের অভিযোগ সত্যি। জালিয়াতি করে ওই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা গায়েব করেছে প্রতারকরা। ব্রিটেনের আইন অনুযায়ী, দ্রুত ওই গ্রাহকের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করেন ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ। তার ফলে বিশাল ক্ষতি হয় ব্যাঙ্কের। শুরু হয় ব্যাঙ্কের অভ্যন্তরীন তদন্ত।

সেই তদন্তে উঠে আসে, বিলেতের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে জালিয়াতির টাকা সোজা এসেছে ভারতে। কলকাতার কয়েকটি অ্যাকাউন্টের হদিশ পাওয়া যায়। যেখানে ওই টাকা জমা পড়েছে। তদন্তে উঠে আসে, যে অ্যাকাউন্টগুলোতে ওই টাকা জমা পড়েছে সেগুলোয় ওই গ্রাহকের টাকা ছাড়াও, ইংল্যান্ডের আরও বেশ কিছু নাগরিকের টাকা জমা পড়েছে গত কয়েক সপ্তাহে। সেই টাকার মোট অঙ্ক দেড় কোটি টাকারও বেশি।

Advertisement

আরও পড়ুন: ‘রামজন্মভূমি মুক্ত হল’, ১৫ অগস্টের সঙ্গে তুলনা টানলেন মোদী

কলকাতার এ রকম প্রায় ৩৫টি অ্যাকাউন্টের হদিশ পান তদন্তকারীরা। যে অ্যাকাউন্টগুলোতে গত কয়েক সপ্তাহে ইংল্যান্ডের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা জমা পড়েছে। ওই অ্যাকাউন্টগুলোর পুরনো লেনদেন খতিয়ে দেখতে গিয়ে তাজ্জব হয়ে যান তদন্তকারীরা। দেখা যায়, বছর দুয়েক ধরে প্রতিটি অ্যাকাউন্টই ব্যাঙ্কিং পরিভাষায় ‘ডরম্যান্ট’ বা নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছে। যখন সক্রিয় ছিল অ্যাকাউন্টগুলো তখনও লেনদেনের অঙ্ক হাজারের গণ্ডি ছাড়ায়নি। প্রত্যেকটি অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রেই একটি অদ্ভুত মিল খুঁজে পান তদন্তকারীরা। দেখা যায়, প্রতিটি অ্যাকাউন্টই একটি নির্দিষ্ট সময়ে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এবং সেখানে ইংল্যান্ড থেকে মোটা অঙ্কের টাকা জমা পড়েছে। টাকা জমা পড়ার পর পরই তা আবার চলে গিয়েছে অন্য অ্যাকাউন্টে। ব্যাঙ্কের এক তদন্তকারী আধিকারিক বলেন, ‘‘অ্যাকাউন্ট যাঁদের নামে রয়েছে, তাঁদের সম্পর্কে খোঁজ খবর করতে গিয়েও আমরা জানতে পারি, বিদেশ থেকে মোটা অঙ্ক আসার মতো কোনও যোগ তাঁদের নেই।”

সেখান থেকেই তদন্তকারীদের সন্দেহ হয়, সব ক’টি অ্যাকাউন্টই আসলে ‘মিউল অ্যাকাউন্ট’। অর্থাৎ প্রতারক বা হাওয়ালা কারবারিরা টাকার লেনদেনের জন্য যে ‘ভাড়া’র অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেন নিজেদের আড়ালে রাখতে। অ্যাকাউন্টের মালিকের কাছ থেকে প্রতারক বা হাওয়ালা কারবারিরা একটি নির্দিষ্ট কমিশনের বিনিময়ে ওই অ্যাকাউন্টগুলি নিজেদের লেনদেনের জন্য ব্যবহার করেন। অ্যাকাউন্টের মালিককে পরে পুলিশ ধরলেও আড়ালে থেকে যান মূল কারবারিরা।

ইতিমধ্যে ইংল্যান্ডের গ্রাহকের টাকা কী ভাবে জালিয়াতি হয়েছে তা নিয়েও প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট আসে বিলেত থেকে। জানা যায়, ওই গ্রাহক একটি ফোন পেয়েছিলেন কোনও অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তির কাছ থেকে। সেই ব্যক্তি ওই গ্রাহককে একটি অ্যাপ ডাউনলোড করতে বলেন। জানানো হয়, একটি বিশেষ পরিষেবা পাওয়া যাবে ওই অ্যাপ থেকে। ওই অ্যাপ ডাউনলোড হওয়ার পরেই গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে কয়েক দফায় মোটা অঙ্কের টাকা উধাও হয়ে যায়। তদন্তকারীরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন, আসলে ওই অ্যাপের আড়ালে ছিল একটি বিশেষ লিঙ্ক যা জামতাড়ার প্রতারকরাও ব্যবহার করে ‘টার্গেট’-এর মোবাইলের নিয়ন্ত্রণ নিতে। ওই লিঙ্কে ক্লিক করা মাত্র গ্রাহকের মোবাইলের সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ চলে যায় প্রতারকের হাতে। আর সেই নিয়ন্ত্রণ নিয়েই মোবাইল ব্যাঙ্কিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকের টাকা লোপাট করেছে জালিয়াতরা।

অন্য দিকে, কলকাতায় আসা টাকার হদিশ করতে গিয়ে তদন্তকারীরা জানতে পারেন, ওই ‘ভাড়া’র অ্যাকাউন্ট থেকে হয় নগদে টাকা উঠেছে নয়তো কয়েকটি বিশেষ অ্যাকাউন্টে গিয়ে জমা হয়েছে। এ রকম একটি অ্যাকাউন্টের হদিশ করতে গিয়ে দেখা যায়, সেটি একবালপুর এলাকার বাসিন্দা এক যুবকের। যে ব্যাঙ্কে প্রতারণা হয়েছে সেই ব্যাঙ্কেও ওই যুবকের অ্যাকাউন্ট ছিল যা গত দু’বছর নিষ্ক্রিয়। তদন্তে উঠে এসেছে, সম্প্রতি ওই যুবকের এবং তাঁর দাদার অ্যাকাউন্টে নিয়মিত মোটা টাকার লেনদেন হচ্ছে। অথচ বাস্তবে তাঁদের সে রকম কোনও ব্যবসা নেই যা থেকে ওই পরিমাণ টাকার লেনদেন হতে পারে। তদন্তকারীদের সন্দেহ, বন্দর এলাকার ওই যুবকদের সঙ্গে যোগ রয়েছে মূল জালিয়াত চক্রের।

আরও পড়ুন: নবযুগের শুরু, বললেন মোহন ভাগবত, রুপোর ইট গেঁথে সূচনা রামমন্দিরের

কলকাতা পুলিশের ব্যাঙ্ক জালিয়াতি শাখার কাছে ইতিমধ্যেই জমা পড়েছে ওই প্রতারণার অভিযোগ। গোয়েন্দাদের ধারণা, কলকাতায় বসে একটি বড় চক্র জামতাড়া গ্যাংয়ের কায়দাতেই কোটি কোটি টাকা প্রতারণা করছে বিদেশের নাগরিকদের। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘ব্যাঙ্কের কাছ থেকে আমরা অভিযোগ পেয়েছি। গোটাটাই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন