অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।
দক্ষিণ কলকাতার একটি অভিজাত আবাসনের ৩০ তলার ফ্ল্যাটের একটি ঘরে একা বসে এক ব্যক্তি। সামনে খোলা ১০টি ল্যাপটপ ও ১৪টি মোবাইল। এক-এক বার এক-একটি ফোন রিসিভ করে ল্যাপটপে কিছু নোট করছে সে। আচমকাই সেখানে হাজির জনা
ছয়েক যুবক। ওই ব্যক্তি কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়লেন ওই যুবকেরা।
পুলিশ জানায়, বেটিং চক্র চালানোর অভিযোগে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সাউথ সিটির তিন নম্বর টাওয়ারের ৩০ তলা থেকে এ ভাবেই গ্রেফতার হল এক ক্রিকেট-জুয়াড়ি। ধৃতের নাম ওমপ্রকাশ তীর্থানি। তার ঘর থেকে মিলেছে ১১টি ল্যাপটপ, ১৪টি মোবাইল, ভয়েস রেকর্ডার-সহ নগদ দু’লক্ষ ছত্রিশ হাজার টাকা। পুলিশ জানায়, ওই সময়ে আইপিএলের কলকাতা নাইট রাইডার্স এবং মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের খেলার উপরেই চলছিল ক্রিকেট জুয়া।
লালবাজার সূত্রে খবর, ধৃত ওমপ্রকাশ বীরভূমের বেশ কিছু খনির মালিক। আদতে আমদাবাদের বাসিন্দা ওই ব্যক্তি দীর্ঘ দিন ধরেই রয়েছে কলকাতায়। প্রথমে সে বেটিং ব্যবসা শুরু করে বেহালায় নিজের বাড়িতে। পুলিশের কাছে ওমপ্রকাশের দাবি, গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিতে গত চার বছর ধরে ওই আবাসনের ৩০ তলায় বেটিং চক্র চালাচ্ছিল সে। কারণ, সেখানে যাতায়াতের খুব কড়াকড়ি। তার ধারণা হয়েছিল, সেখানে সহজে কেউ তার নাগাল পাবে না।
গোয়েন্দা সূত্রে খবর, আইপিএল শুরু হওয়ার পরেই তাঁরা জানতে পারেন শহরে ক্রিকেট বেটিং চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু সম্ভাব্য সমস্ত জায়গায় খোঁজ নিয়েও প্রথমে কোনও বেটিং চক্রের সন্ধান পাননি তাঁরা। তদন্তকারীরা জানান, সপ্তাহখানেক আগে তাঁরা একটি সূত্রে ওমপ্রকাশের কথা জানতে পারেন। দেখা যায়, শহরে তার চারটি বাড়ি। কিন্ত কোন বাড়ি থেকে বেটিং চক্র চলছে, তা বোঝা যাচ্ছিল না। এক গোয়েন্দা কর্তা বলেন, ‘‘ওমপ্রকাশকে নজরে রাখতে গিয়ে দেখি, প্রতিদিন আইপিএলের খেলা শুরুর আগে সে ওই বহুতলের তিরিশ তলায় যায় এবং ম্যাচ শেষে বেরিয়ে যায়। তাতেই সন্দেহ হয়। বৃহস্পতিবার রাতে খেলা চলাকলীন আমরা হানা দিয়ে হাতেনাতে ধরি ওই যুবককে।’’
কী ভাবে কাজ করে জুয়া-চক্র? গোয়েন্দারা জানান, বিদেশের একটি ওয়েবসাইট খেলা অনুযায়ী জুয়ার দর ঠিক করে। এ দেশের জুয়া-চক্রের পাণ্ডারা সেই ওয়েবসাইটে মোটা টাকা বিনিয়োগ করে ‘মাস্টার কোড’ কেনে। সেই কোড তারা ফোনে বিলি করে বিভিন্ন এজেন্ট ও সাব-এজেন্টকে, যারা স্থানীয় স্তরে গিয়ে জুয়া-চক্র চালায়। গোয়েন্দাদের দাবি, ওমপ্রকাশও তেমনই এজেন্ট। উদ্ধার হওয়া ফোনগুলিতে দেশের বিভিন্ন শহর থেকে বুকিরা ফোন করে কোড বলত। গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, এ শহরে ওমপ্রকাশ ছাড়াও আরও চার জন এমন এজেন্ট রয়েছে। তাদের খোঁজ শুরু হয়েছে।
গোয়েন্দারা জানান, ক্রিকেট বেটিং চক্র মূলত চলে বিশ্বাসের উপরে ভিত্তি করে। নতুন যারা টাকা লাগাবে, তাদের জন্য প্রয়োজন এক জন ‘গ্যারান্টার’-এর। ফোন করে বাজির দর লাগানো হয়। কেউ যাতে পরে তা অস্বীকার না করে, তাই দামি ভয়েস রেকর্ডার
ব্যবহার করা হয়। যা ওমপ্রকাশের ঘর থেকে উদ্ধার হয়েছে। গোয়েন্দারা জেনেছেন, খেলার পর থেকে অন্তত ১২ ঘণ্টার মধ্যে বুকিদের এজেন্টরা টাকা লেনদেন করে।
গোয়েন্দাদের দাবি, ওমপ্রকাশ জানিয়েছে শুধু আইপিএল-ই নয়, বিশ্বকাপ ও অন্য টুর্নামেন্টেও জুয়া-চক্র চলে কলকাতায়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মোবাইলে বুকিদের ফোন আসে। লালবাজার সূত্রে খবর, কোন কোন দলের খেলা, সেই অনুযায়ী জুয়ার দরের হেরফের হয়। অনেক সময়ে ম্যাচ চলাকালীন জুয়ার বাজি ওঠানামা করে। দেশের বিভিন্ন রাজ্যে জুয়ার টাকার লেনদেন হয় হাওলার মাধ্যমে। আর কলকাতায় নগদ টাকায়।