আহত রাজা দাস (বাঁ দিকে)। রক্তে ভেসে যাচ্ছে কৃষ্ণনগর লোকালের কামরা। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।
ভোর তখন চারটে। দিনের আলো ভাল করে ফোটেনি। শিয়ালদহ থেকে কৃষ্ণনগরগামী প্রথম লোকাল ট্রেনটি সবে টিটাগড় স্টেশন পার হয়েছে। হঠাৎই মাঝের দিকের একটি কামরায় প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠেন যাত্রীরা। দেখা যায়, যে কামরাটিতে বিস্ফোরণ হয়েছে, সেটি ভরে গিয়েছে ধোঁয়ায়। ভিতর থেকে ভেসে আসছে আর্তনাদ। এই ঘটনায় গোটা ট্রেন জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। অনেক যাত্রীই ভয়ের চোটে চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেন।
কয়েক মিনিট পরেই ট্রেনটি ঢোকে ব্যারাকপুর স্টেশনে। ট্রেন থেকে নেমে সবাই তখন প্রাণ হাতে নিয়ে পালাচ্ছেন। পাশের প্ল্যাটফর্মের যাত্রীরাও ‘বোমা ফেটেছে’ চিৎকার শুনে ছুটতে শুরু করেন এ দিক-ও দিক। প্রবল হুড়োহুড়ির মধ্যেই ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়া কামরার কাছে পৌঁছে হতভম্ব হয়ে যান কয়েক জন রেলকর্মী। তাঁরা দেখেন, গোটা কামরা ভেসে যাচ্ছে রক্তে। তার মধ্যেই পড়ে আছেন সাত জন। কারও মাথার পিছনের খুলি উড়ে গিয়েছে, কারও উড়ে গিয়েছে হাত, কারও শরীর ঝলসে গিয়েছে বিস্ফোরণে। এ ছাড়াও ছোটখাটো চোট পেয়েছেন আরও জনা পনেরো যাত্রী। আহতদের প্রথমে স্থানীয় বি এনবসু হাসপাতালে এবং পরে শিয়ালদহের বি আর সিংহ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
মঙ্গলবার ভোরের এই ঘটনার তদন্তে নেমে রেল পুলিশ এবং বিধাননগর কমিশনারেটের তদন্তকারীরা প্রথমে জানান, কামরার মধ্যে দু’দল দুষ্কৃতীর লড়াইয়ের পরিণতিতে এই বোমা-বিস্ফোরণ। যদিও রাতে এই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ভোলা চৌধুরী ওরফে কানা ভোলা, সাদ্দাম হোসেন ওরফে বাঁইয়া এবং রাহুল দাস নামে তিন জনকে পাকড়াও করে জেরার পরে পুলিশের দাবি, মোবাইল চুরির জন্য রাজা দাসকে গণপিটুনি দেওয়ার সময়েই তার হাতের ব্যাগে রাখা কৌটো বোমা ফেটে এই ঘটনা ঘটেছে।
এ দিনের ঘটনার জেরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে শিয়ালদহের বিভিন্ন শাখার যাত্রী মহলে। ভোরবেলা যে ভাবে যাত্রী বোঝাই কামরায় বিস্ফোরণ হয়েছে, তার পরে রেলের নিরাপত্তার বেআব্রু ছবিটাই ফুটে উঠেছে বলে অভিযোগ করেন বহু যাত্রী। বিশেষ করে, কী ভাবে রেল পুলিশের চোখ এড়িয়ে ব্যাগে বোমা নিয়ে রাজা দাস ট্রেনে উঠল, সে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। যাত্রীদের অভিযোগ, নিরাপত্তা ব্যবস্থা কড়া হলে এমন ঘটনা ঘটত না।
যাত্রী ট্রেনে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় উদ্বিগ্ন রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু। ওই ঘটনার পরেই রেল বোর্ডের কাছে রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছেন তিনি। রেলভবন সূত্রে জানানো হয়েছে, কেন ওই ঘটনা ঘটলো, তা জানিয়ে পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজারের থেকে বিস্তারিত রিপোর্ট চেয়েছে দিল্লি। বর্তমানে রাজ্য পুলিশের সঙ্গেই ওই ঘটনার তদন্ত করছে রেল পুলিশ। সেই রিপোর্টও চেয়েছে দিল্লি। শিয়ালদহের ডিআরএম জয়া বর্মা বলেন, ‘‘কারা বোমা এনেছিল, তা দেখা হচ্ছে। ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা কামরাটি পরীক্ষা করেছেন।’’ ঘটনাটি নিয়ে এ দিনই রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিবকে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন এডিজি রেল এম কে সিংহ। বিস্ফোরণের খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে পৌঁছন রেলের একাধিক শীর্ষ কর্তা। জয়া বর্মা মেডিক্যাল রিলিফ ট্রেন নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে আহতদের বি আর সিংহ হাসপাতালে আনার ব্যবস্থা করেন। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, জখমদের হাসপাতালে ভর্তি রাখা হয়েছে। এর মধ্যে এক বিএসএফ জওয়ান-সহ চার জনের অবস্থা গুরুতর। এ ছাড়াও ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে আহত হয়েছেন কয়েক জন। প্রাথমিক চিকিৎসার পরে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
ধৃত তিন জনকে জেরার পরে তদন্তকারীরা দাবি করেন, রাজা, কানা ভোলা এবং বাঁইয়া নেশার জন্য প্রায় দিনই ট্রেনে চুরি-ছিনতাই করে। এ দিনও তারা ভোরের ওই ট্রেনটিতে ওঠে এবং দু’টি মোবাইল ছিনতাই করে। কাজ সেরে কানা ভোলা নেমে গেলেও আটকে পড়ে বাঁইয়া ও রাজা। এ সময় কামরাটিতে যথেষ্ট ভিড় ছিল বলে ধৃতেরা পুলিশকে জানিয়েছে। মোবাইল ছিনতাইবাজ সন্দেহে ট্রেনের কয়েক জন রাজাকে পেটাতে শুরু করেন। তদন্তকারীদের দাবি, সেই দলে ছিলেন অলোক শীল নামে এক বিএসএফ জওয়ানও। বাঁইয়া ভিড়ের মধ্যে ঢুকে রাজাকে বাঁচাতে যায়। তখনই টানাটানিতে রাজার হাতে থাকা ব্যাগে রাখা একটি কৌটো বোমা ফাটে বলে ধৃতেরা জানিয়েছে। আতঙ্কে বহু যাত্রী আহত হলেও তাঁরা ভয়ে পালিয়ে যান। যে মোবাইল দু’টি তারা ছিনতাই করেছিল, সেগুলি ধৃতদের থেকে উদ্ধার হলেও সেগুলির প্রকৃত মালিকের খোঁজ মিলছে না বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে।
বিস্ফোরণে রাজার ডান হাত ও মাথার খুলির একাংশ উড়ে গিয়েছে। জখম হয়েছেন ওই জওয়ান-সহ ছ’জন। বি আর সিংহ হাসপাতালে ভর্তি রাজার অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এ দিন সকালে বি এন বসু হাসপাতালে বসেছিলেন ওই কামরার যাত্রী ৬৫ বছরের জাহানারা বেগম। পরণের সাদা শাড়িতে রক্তের দাগ। তাঁর জখম ছেলের চিকিৎসা চলছে। আতঙ্কিত বৃদ্ধা বলেন, ‘‘আমিও টিটাগড় থেকে ওই কামরায় উঠেছিলাম। দু’জন আমাকে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ে। শুরু হয় গোলমাল। তার পরেই কানে তালা ধরানো শব্দে কেঁপে উঠি। একটু পরে দেখি ধোঁয়ার মধ্যে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে আমার ছেলে। রক্ত বেরোচ্ছে আমার ঘাড় থেকেও।’’ আর এক যাত্রীর মন্তব্য, ‘‘কয়েক দিন আগে মধ্যমগ্রামে প্রকাশ্য রাস্তায় দু’দল সমাজবিরোধীর গুলির লড়াইয়ের কথা শুনেছিলাম। এ বার ট্রেনের কামরায় সেটা দেখলাম!’’