হন্যে হয়ে ট্যাক্সি ধরার চেষ্টা। বুধবার। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
অনিয়ম ধরতে পথে নেমেছে সরকার। আর সরকার কঠোর হতেই অভিভাবকদের সমস্যায় ফেলার পথে হাঁটতে শুরু করলেন স্কুলগাড়ি ও স্কুলবাস মালিকদের একাংশ। কারণ, স্কুলগাড়ি ও স্কুলবাস দাঁড় করিয়ে তাদের চাকা ও কাগজপত্র পরীক্ষা করতেই বহু ক্ষেত্রে উঠে আসছে নানা অনিয়ম। বৃহস্পতিবারও অভিযান চালিয়ে ধরা হয় তিনটি স্কুলগাড়ি।
বুধবার শহরের বেশির ভাগ স্কুলগাড়ি ও স্কুলবাস পথে না নামায় চূড়ান্ত দুর্ভোগে পড়তে বহু অভিভাবকদের, যাঁদের বাড়ির বাচ্চারা এই সব গাড়ি ও বাসে স্কুলে যাতায়াত করে। সময়ে পৌঁছে দিতে অভিভাবকেরা নিজেরাই বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে ছুটেছেন। বহু বাচ্চা এ দিন স্কুলে যেতেও পারেনি। অফিস কামাই করে অনেকে বাচ্চাকে স্কুল থেকে বাড়ি নিয়ে গিয়েছেন। এমনকী সকালে স্কুলগাড়ি স্কুলে পৌঁছে দিয়ে দুপুরে আর বাচ্চাকে নিতে যায়নি এমন ঘটনাও ঘটেছে। সেই শিশু স্কুলে বহুক্ষণ বসে থাকার পরে স্কুলের তরফে অভিভাবককে যোগাযোগ করে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
এ ভাবে স্কুলগাড়ি ও স্কুলবাস মালিকদের একাংশ সরকারকে চাপে রাখতে চাইলেও নিজেদের অবস্থান থেকে এতটুকু সরতে নারাজ সরকার। বুধবার পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘‘অভিযান চলবে। সে জন্য ছোটখাটো ঘটনা ঘটতেই পারে। অনিয়ম দেখলেই আমরা ব্যবস্থা নেব।’’ রাস্তায় স্কুলগাড়ি না থাকা প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ‘‘সরকারি ভাবে আমার কাছে এমন কোনও খবর নেই। হলেও তা বিচ্ছিন্ন ঘটনা।’’
বাঘাযতীন থেকে বাসে বালিগঞ্জ শিক্ষা সদনে এসেছিলেন সুচিত্রা দাস। জানালেন, পুলিশি ধরপাকড়ের জেরে স্কুলগাড়ির চালক জানিয়েছেন তিনি যাবেন না। সাউথ পয়েন্টের এক ছাত্রীর অভিভাবক স্বাতী চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আমার স্বামীর ভিন্ রাজ্যে চাকরি। আমি কলেজে পড়াই। স্কুলগাড়ি না থাকায় মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে পারছি না।’’
ইতিমধ্যে স্কুলগাড়ি ও স্কুলবাস মালিকদের অনেক সংগঠন তৈরি হয়ে গিয়েছে। কারও সঙ্গে কারও কার্যত যোগাযোগ বা নিয়ন্ত্রণও নেই। তবে এ ভাবে দুম করে গাড়ি ও বাস চালানো বন্ধ করে দেওয়াটা সরাসরি সমর্থন না করলেও বিরোধীতাও করছে না তাদের বেশির ভাগই। জানানো হয়েছে, সংগঠনের তরফে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়নি। যাঁরা বন্ধ রেখেছেন, তাঁদের নিজেদের সিদ্ধান্ত। পুলকার ওনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের নেতা অরূপম দত্তের কথায়, ‘‘আমরা গাড়ি বন্ধ করতে বলিনি। কিন্তু অনেকে এ দিন গাড়ি বার করেননি বলে শুনেছি।’’
সমস্যার সূত্রপাত ২৪ জুন। সে দিন পড়ুয়া-সহ একটি স্কুলবাস তপসিয়ার কাছে দুর্ঘটনায় পড়ে। মারা যান চালক বিশ্বনাথ সামন্ত। জানা যায়, বাসের চাকা মসৃণ হয়ে যাওয়ায় ব্রেক ঠিক মতো কাজ করেনি। তার পরের শুক্রবার আর জি কর হাসপাতালের কাছে ফের একটি স্কুলবাস দুর্ঘটনায় পড়ে। সে দিনও বাসের চাকাই যে দুর্ঘটনার কারণ, জানিয়েছিল পুলিশ। ১১ জুলাই সল্টলেকে দু’টি স্কুলগাড়ির মুখোমুখি ধাক্কার ঘটনাতেও দেখা যায় একটি গাড়ির চাকা ঠিক নেই।
এর পরে মমতার নির্দেশে নড়ে বসে প্রশাসন। যে সব গাড়ি ও বাস বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে যাতায়াত করে, সেগুলির রক্ষণাবেক্ষণ কেমন হচ্ছে, তা দেখতে পুলিশকে নিয়ে পথে নামেন পরিবহণ দফতরের অফিসারেরা। এখানেই শুরু হয় সংঘাত।
গত সোম ও মঙ্গলবার ১১০টি স্কুলগাড়ি ও স্কুলবাস দাঁড় করিয়ে তাদের চাকা ও কাগজপত্র পরীক্ষা করতেই উঠে আসে অন্য তথ্য। স্কুলে যাতায়াতের জন্য পরিবহণ দফতর বিশেষ একটি ছাড়পত্র দেয়। দেখা যায়, বেশির ভাগের সেই ছাড়পত্রই নেই। বাণিজ্যিক ছাড়পত্র নিয়েই চলছে যাতায়াত। অনেকের আবার বাণিজ্যিক ছাড়পত্রও নেই। অর্থাৎ, সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে বাচ্চাদের নিয়ে দিনের পর দিন রাস্তায় চলছে গাড়িগুলি। এমনই এক গাড়ির মালিক রাজু সামন্ত বলেন, ‘‘চার বছর আগে আবেদন করেছি। এখনও পাইনি। কিন্তু, সে জন্য রাস্তায় গাড়ি চালাতে এত দিন কোনও অসুবিধা হচ্ছিল না।’’
স্কুলগাড়ি ও স্কুলবাস মালিকদের অভিযোগ, সরকারের নিয়ম বেশ জটিল। তা মানলে লোকসান হবে তাঁদের। স্কুলগাড়ি সর্বাধিক তিনটে জেলায় চালানোর পারমিট পায়। বাণিজ্যিক গাড়ি একই পরিমাণ কর দিয়ে দার্জিলিং ছাড়া সব জেলায় চালাতে পারে। শুধু স্কুলগাড়ির ছাড়পত্র থাকলে অন্য কোথাও ভাড়া খাটানো যায় না। ফলে স্কুলে লম্বা ছুটির সময়ে গাড়ি কার্যত বসিয়ে রাখতে হয়। অরূপম দত্তও জানিয়েছেন, অনেক গাড়িরই স্কুলগাড়ির ছাড়পত্র নেই, শুধুমাত্র বাণিজ্যিক গাড়ির ছাড়পত্র রয়েছে। স্বভাবতই, এখন ওই গাড়িতে বাচ্চাদের নিয়ে গেলে পুলিশ জরিমানা করবে। তাই সংশ্লিষ্ট গাড়ির মালিকেরা গাড়ি বার করেননি।