chitpur

বাঘের ডেরায় হত নরবলি, চিতু ডাকাতের দেবী চিত্তেশ্বরীর মন্দির থেকে জন্ম নিল চিৎপুর

এখানে পুজো দিয়েই তাঁর দল নাকি যেত ডাকাতিতে। এই অঞ্চলের সঙ্গে ডাকাতির উল্লেখ অতীতে বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। বলা হয়, ডাকাতদলের উপদ্রব এবং চিত্তেশ্বরী মন্দিরে নরবলি সহ্য করতে না পেরে চিৎপুর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন মনোহর ঘোষের বংশধরেরা।

Advertisement
নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৬:৩৪
Share:
০১ ১০

কলকাতার কিছু রাজপথের নামকরণ হয়েছিল ‘কলকাতা’রও জন্মের আগে। এখনও রয়ে গিয়েছে সেই সব নাম। ‘চিৎপুর রোড’ সে রকমই একটি উদাহরণ। পথের উৎপত্তি হালিশহরে। সেখান থেকে শুরু হয়ে সর্পিল, কাঁচা পথ চলে গিয়েছিল পূর্ববঙ্গের যশোরে। পথে পড়ত দেবী চিত্তেশ্বরী ও কালীঘাটের মন্দির। এই ‘চিত্তেশ্বরী’ মন্দির থেকেই এলাকার নাম হয় চিৎপুর এবং যে পথে দেবীর মন্দিরের কাছে যাওয়া যায় তার নাম হয়ে যায় ‘চিৎপুর রোড’। আমাদের কাছে যার পরিচয় রবীন্দ্র সরণি।

০২ ১০

শুরুতে এই পথের নাম ছিল ‘তীর্থক্ষেত্র যাইবার পথ’ বা সাহেবদের কাছে ‘ওল্ড পিলগ্রিমেজ রোড’। পথ নাকি বানিয়েছিলেন সাবর্ণ রায়চৌধুরীর পরিবার। তখন হালিশহরে থাকত তাঁদের বড় তরফ এবং বড়িশায় বসত ছিল ছোট তরফের। তবে একটা বিষয় বারবার মনে করিয়ে দেন কলকাতা-বিশেষজ্ঞরা। তা হল, চিৎপুর এলাকা এবং চিৎপুর রোডের মধ্যে বিস্তর ফারাক।

Advertisement
০৩ ১০

বাগবাজার খালের উত্তরদিকে চিত্তেশ্বরীপুর বা চিত্রপুর বা চিৎপুর দীর্ঘদিন ধরেই ছিল। বিপ্রদাস পিপিলাই-এর ‘মনসামঙ্গল কাব্য’ এবং মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে চিৎপুরের উল্লেখ আছে। ষোড়শ শতকের শেষে কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম তাঁর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে লেখেন ‘ত্বরায় চলিল তরী তিলেক না রয়/ চিৎপুর সালিখা এড়াইয়া যায়’। কিন্তু দেবী চিত্তেশ্বরীর মন্দির কবে স্থাপিত হয়েছিল, তা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। কথিত, ষোড়শ শতকে এই মন্দির বানিয়েছিলেন মনোহর ঘোষ (মতান্তরে মহাদেব ঘোষ)। সম্রাট আকবরের মনসবদার ও টোডরমলের গোমস্তা ছিলেন তিনি।

০৪ ১০

চিত্তেশ্বরী মন্দিরের পাশাপাশি নির্মিত হয়েছিল সর্বমঙ্গলা মন্দিরও। কিন্তু এই দুই পীঠস্থানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ডাকাতের গল্পও। বলা হয়, দুঃসাহসী চিতু ডাকাত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই দু’টি মন্দির। এখানে পুজো দিয়েই তাঁর দল নাকি যেত ডাকাতিতে। এই অঞ্চলের সঙ্গে ডাকাতির উল্লেখ অতীতে বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। বলা হয়, ডাকাতদলের উপদ্রব এবং চিত্তেশ্বরী মন্দিরে নরবলি সহ্য করতে না পেরে চিৎপুর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন মনোহর ঘোষের বংশধরেরা।

০৫ ১০

তবে দেবী চিত্তেশ্বরী কিন্তু কালী নন। তিনি দেবী দুর্গার এক রূপ। গবেষকরা বলেন, এই একটি ক্ষেত্রেই দেবী দুর্গাকে পুজো করেছেন বাংলার ডাকাতরা। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ফারুখশিয়ারের সনদে ৩৮টি গ্রাম ব্রিটিশদের লিজ নেওয়ার সম্মতি দেওয়া হয়। তার মধ্যে একটি ছিল চিৎপুর। এই অঞ্চল দীর্ঘ দিন অবধি কুখ্যাত ছিল বাঘের উপদ্রবের জন্য।

০৬ ১০

এই চিত্তেশ্বরী মন্দির লাগোয়া অংশই চিৎপুর এবং মন্দিরে যাওয়ার পথ হল চিৎপুর রোড। এই মত সমর্থন করেন অধিকাংশ কলকাতা-গবেষক। তবে এর বাইরে কেউ কেউ আবার বলেন, চিৎপুর হল চিত্রপুরের অপভ্রংশ। এখানে চিত্রিত সুতির শাড়ি বোনা হত। বণিক সম্প্রদায় শেঠ ও বসাকদের মধ্যে সে শাড়ির চাহিদা ছিল আকাশছোঁয়া।

০৭ ১০

ব্রিটিশ আমলে কুমোরটুলি, জোড়াসাঁকো, কলুটোলা, বৌবাজার এলাকায় দেশীয় জনবসতি বেশি ছিল। ইউরোপীয়রা এখানে বিশেষ পা রাখতেন না। অরমি সাহেব বিবরণ দিয়েছিলেন, জোড়াবাগান, কুমোরটুলিতে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের বাড়িঘর লুঠ করেছিল নবাব সিরাজের বাহিনী। ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে মেজর আই পি শক এবং ক্যাপ্টেন টি প্রিন্সেপ কলকাতার যে মানচিত্র এঁকেছিলেন, সেখানে ঘনবসতিপূর্ণ চিৎপুরে কুঁড়েঘর, এঁদো পুকুর, খাল, ডোবা, জঙ্গল এবং কৃষিজমি বেশি দেখানো হয়েছে। (১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে এডওয়ার্ড প্রিন্সেপের আঁকা ছবি)

০৮ ১০

উপনিবেশ কলকাতায় বিভাজন স্পষ্ট ছিল। চৌরঙ্গি, পার্ক স্ট্রিট ছিল হোয়াইট টাউন। অন্যদিকে, চিৎপুর ছিল ব্ল্যাক টাউনের মধ্যে। দু’টি অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য ছিল দৃষ্টিকটু। হোয়াইট টাউন ছিল যতটা পরিষ্কার, ব্ল্যাক টাউন ছিল অপরিচ্ছন্ন।উপনিবেশের দু’টি অংশের চেহারার আকাশপাতাল বিভেদ ছিল। ( ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে সিম্পসন উইলিয়ামের আঁকা ছবি)

০৯ ১০

পরবর্তীকালে চিৎপুর পটশিল্প, খেউড়, কবিগানের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে। সিপাহি বিদ্রোহের পরে উনিশ শতকের মাঝামাঝি নির্বাসিত নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিটি ক্ষেত্র আরও বেশি সমৃদ্ধ হয়। এখন কলকাতার যাত্রাপাড়া বোঝাতে চিৎপুরকেই বলা হয়।

১০ ১০

সুদীর্ঘ চিৎপুর রোডকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। বাগবাজার খাল থেকে বাগবাজার স্ট্রিট অবধি অংশ হল চিৎপুর অ্যাপ্রোচ। বাগবাজার স্ট্রিট থেকে দক্ষিণ মেছুয়াবাজার স্ট্রিট অবধি এলাকা হল আপার চিৎপুর রোড। মেছুয়াবাজার থেকে বৌবাজার, লালবাজার স্ট্রিট হল লোয়ার চিৎপুর রোড। (ঋণস্বীকার: কলিকাতার রাজপথ সমাজে ও সংস্কৃতিতে: অজিতকুমার বসু, কলিকাতা দর্পণ: রাধারমণ মিত্র) (ছবি: আর্কাইভ, শাটারস্টক ও সোশ্যাল মিডিয়া)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
Advertisement
আরও গ্যালারি
Advertisement