রেস্তোরাঁর সঙ্গেই হারিয়ে গেল সাধের চপসোয়ে

সেটা সেই সময়, যখন পাড়ায় পাড়ায় কাফে কফি ডে, বারিস্তা ছিল না। সেটা সেই সময়, যখন টেলিফোন ঘুরিয়ে অর্ডার দিলে কুড়ি মিনিটের মধ্যে সাঁ করে মোটর বাইকে করে পিৎজা ঘরে পৌঁছে যেত না।

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৬ ০৮:৩৭
Share:

সেটা সেই সময়, যখন পাড়ায় পাড়ায় কাফে কফি ডে, বারিস্তা ছিল না। সেটা সেই সময়, যখন টেলিফোন ঘুরিয়ে অর্ডার দিলে কুড়ি মিনিটের মধ্যে সাঁ করে মোটর বাইকে করে পিৎজা ঘরে পৌঁছে যেত না। সেটা সেই সময়, সিঙাড়ার দোকানে বার্গার পাওয়া যেত না। সেটা সেই সময়, যখন ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলে বন্ধু-বান্ধবী, প্রেমিক-প্রেমিকার আশ মেটানোর সুযোগ ছিল না— দেখা করে কোথাও বসতে হত।

Advertisement

সেটা ছিল বিগ ম্যাক্স-এর সময়।

পার্ক স্ট্রিট আর লিটল রাসেল স্ট্রিটের মোড়ে, ১-এ রাসেল স্ট্রিটে এক ছাদের তলায় তিন দ্রষ্টব্য একই সদর দরজা দিয়ে ঢুকলে। সোজা গেলে খেলনার দোকান ‘ইন্ডিয়াজ হবি সেন্টার’, বাঁ দিকে আইসক্রিম পার্লার ‘সাব জিরো’, ডাইনে ‘বিগ ম্যাক্স’।

Advertisement

বিগ ম্যাক্স। মূলত অল্পবয়সীদের ‘হ্যাংআউট’-এর জায়গা, তবে যেতেন মাঝবয়সীরাও। একই সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার ও কম দামে হরেক রকম উৎকৃষ্ট খাবারের ডেরা। চিনা খাবার, পিৎজা, ফিশ ফ্রাই-ফিশ ফিঙ্গার, ক্লাব স্যান্ডুইচ, দক্ষিণ ভারতীয় ধোসা-বড়া-ইডলি, বার্গার-হট ডগ এবং হ্যাঁ, চপসোয়ে— আমেরিকান চপসোয়ে। ওই খাবারটি ছিল বিগ ম্যাক্স-এর সিগনেচার ডিশ। তখনও অত ভাল আমেরিকান চপসোয়ে কলকাতার অন্য কোথাও পাওয়া যেত না, এখনও যায় না। বিগ ম্যাক্স-এ ঢোকার মুখে চপসোয়ের ছবি থাকত। টোম্যাটো সসে জারিত, উপরে একটি ডিমের পোচ রাখা মুচমুচে নুডলস। টেবিলে যেটা আসত, তার সঙ্গে ছবির কোনও অমিল নেই। এখন যে প্রভেদ হরবখত বহু রেস্তোরাঁয় প্রকট।

এক প্লেট ফিশ ফিঙ্গার আর দু’টো সফট ড্রিঙ্ক নিয়ে বিগ ম্যাক্স-এ দুপুর থেকে সন্ধ্যা বসে থাকা যেত। কেউ উঠতে বলত না ওই বাতানুকূল রেস্তোরাঁ থেকে। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই মৃদু ঠান্ডা, আলো ঝলমলে পরিবেশ, হইহই শব্দ আর খাবারের সুবাস— সব মন ভাল করে দেওয়া উপকরণ যেন এক সঙ্গে স্বাগত জানাচ্ছে। জায়গা খুঁজে নিয়ে বসে পড়লেই হল।

তবে সেল্‌ফ সার্ভিস, মানে খাবার নিজেকে নিয়ে আসতে হত। প্রথমেই ক্যাশ কাউন্টারে খাবারের টাকা মিটিয়ে বিলের একটি কপি জমা দিতে হত কিচেন লাগোয়া ফুড ডেলিভারি কাউন্টারে। তার পর টেবিলে বসে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে গল্প করতে করতে আহার্যের জন্য প্রতীক্ষা। একটু পরেই টিং টং। ডেলিভারি কাউন্টারের সামনে, স্ক্রিনে বড় করে ফুটে উঠত বিলের নম্বর। খাবার তৈরি।

যে মান, যে স্বাদ ও যতটা পরিমাণের খাবার যে অবিশ্বাস্য কম দামে ওই রেস্তোরাঁয় পাওয়া যেত, তা এখন ভাবা যায় না। বাসন-কোসন একটি হাল্কা-পুল্কা ধরনের ছিল, খাবার নিজেকে আনতে হত আর গদি মোড়া চেয়ার ছিল না। আর হ্যাঁ, খাবারে সাজসজ্জা বা গারনিশিংয়ের দিকে অতটা মন দেওয়া হত না। তার দরকারও ছিল না অবশ্য।

ফিশ ফিঙ্গার বা ফিশ ফ্রাইয়ে কখনও মাছের পচা গন্ধ পাইনি। ওই রকম গ্রেভি চাউমিন-ও এখন আর কোথাও মেলে না। বিগ ম্যাক্স-এর সেই নুডলস-এর মান ছিল কলকাতার সেরা গ্রেভি চাউমিনের আস্তানা, পার্ক স্ট্রিটের কুলীন চিনা রেস্তোরাঁ, সাবেক ওয়ল্ডর্ফ-এর প্রায় সমতুল (এখনকার ওয়ল্ডর্ফ নয় কিন্তু)। তুলনায় একটু খারাপ ছিল চিলি চিকেন। মাত্রাতিরিক্ত সয়া সসের প্রভাবে কালো।

সেই নয়ের দশকের গোড়াতেই বিগ ম্যাক্স-এর সি থ্রু কিচেন। রান্না কী ভাবে হচ্ছে, তার বেশির ভাগই দেখা যাচ্ছে। এমনকী, আভেন থেকে থরে থরে বেরোচ্ছে বার্গার আর হট ডগের গরম গরম বান। খেতে হবে না, দেখলেই জিভে জল। কত দিন হয়েছে, চার-পাঁচ ঘণ্টা কাটিয়ে বেরোনোর মুখে দেখেছি ওই তৈরি হওয়া বার্গারের রুটির আভেন থেকে আত্মপ্রকাশ আর দৃশ্যেন অর্ধভোজন হয়ে গিয়েছে।

ওই রেস্তোরাঁতেই প্রথম পরিচয় ‘ফ্লোট’-এর সঙ্গে। আইসক্রিম আর সফট ড্রিঙ্কের অনবদ্য মিশেল। বিয়ার মাগের মতো পাত্রে স্ট্র আর চামচ দু’টোই দেওয়া হত। স্ট্র-টা পানীয় টানতে আর চামচটা আইসক্রিম তুলে খেতে। কোলা ফ্লোটে দেওয়া হত ভ্যানিলা আইসক্রিম।

সে সবের ইতি নয়ের দশকের শেষে। শুধু সুস্বাদু খাবার নয়, অনেক স্মৃতিরও সমাধি। তবু অনেক কিছু তো শেষ হয়েও হয় না। সেই কোলাহল, পিৎজা আর চাউমিনের গন্ধ, অদ্ভুত মায়াবি এক আলো ঘুরেফিরে আসে। স্বপ্নে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন