বড়িশায় তৈরি হচ্ছে সেই মণ্ডপ।—নিজস্ব চিত্র।
বড়িশায় বীরেন রায় রোডের বিখ্যাত বঙ্গসন্তানের বাড়ি থেকে মেরেকেটে একশো পা। সেখানেই দেবীপক্ষে ফুটবলায়ন! আর তাতে সামিল কলকাতার তিন প্রধানের তিন ঘরের ছেলে সুব্রত ভট্টাচার্য, ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায় এবং মইদুল ইসলাম!
বেহালা চৌরাস্তা থেকে জেমস লং সরণি পেরোলেই নাবালিয়া। সেই নাবালিয়া ইউনাইটেড ক্লাবের পুজোর থিম এ বার ফুটবল। শুধু থিমই নয়, মণ্ডপটিও গড়া হচ্ছে ফুটবলের আদলে। আর প্রতিমা থাকবে শতাব্দীপ্রাচীন আইএফএ শিল্ডের মধ্যে। শুধু তাই নয়, মণ্ডপে ঢোকার রাস্তা মুড়ে দেওয়া হবে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল-মহমেডান ক্লাবের সাফল্যের নানা মুহূর্তের কোলাজ দিয়ে। কোথাও শ্যাম থাপার বাইসাইকেল কিক, কোথাও শিবদাস-বিজয়দাসদের শিল্ড জয়, কোথাও আবার আসিয়ান কাপ জয় বা সেই তিরিশের দশকে মহমেডানের পরপর পাঁচ বার লিগ জয়ের বিরল সব ছবি। সেরা সব মুহূর্তের ভিডিও দেখানো হবে মণ্ডপের সামনে রাখা পর্দায়। বাদ যাচ্ছে না ক্লাবগুলিকে নিয়ে আড্ডার আসরও।
কুড়ি ফুট ব্যাসের এই ফুটবল কাঠামোটি তৈরি হচ্ছে লোহার পাইপ দিয়ে। তার উপর কংক্রিটের ঢালাই করে তৈরি হচ্ছে মেঝে। আর লোহার পাতের উপর বাঁকানো পাইপগুলি ঝালাই করে তার উপর ধাতব প্লেট এবং পরে চামড়া লাগিয়ে তৈরি হবে বিশাল আকৃতির ফুটবল-মণ্ডপ।
কিন্তু হঠাৎ ফুটবল কেন? ক্লাবের সভাপতি মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “বছর দশেক আগে ফুটবলকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য বাছা হয়। টোকিও থেকে টরোন্টো, সর্বত্রই তো বিভেদ দূর করতে ফুটবল সেরা অস্ত্র।” ক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক কট্টর মোহনবাগান সমর্থক সৌহিত্য বলছেন, “আমাদের তিন ক্লাবে এত রেষারেষি। কিন্তু দিনের শেষে সকলেই এক পাড়ার বাসিন্দা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি থেকে সৌভ্রাতৃত্ব সব কিছু তুলে ধরতেই এই পুজো।” যুগ্ম সম্পাদক ইস্টবেঙ্গল সমর্থক অশোক পোদ্দারের কথায়, “শিল্ডেই তো আমরা পাঁচ গোল দিয়েছিলাম। সেই শিল্ডের মধ্যেই থাকছে প্রতিমা।” যা শুনে এক মোহনবাগান সমর্থক সৃঞ্জন চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “শিল্ড জয়টাই তো আমাদের ক্লাবের সেরা ঐতিহাসিক মুহূর্ত, পাঁচ গোল দিলাম কি না তার চেয়েও বড় সাফল্য।” যে তরজা দেখে স্থানীয় বাসিন্দা ফারুকউদ্দিনও বলে দিলেন, “এই পুজোটাই আমাদের বেরাদরি বাড়াবে।”
পুজোর ভরা বাজারে যখন ভরপুর ব্যস্ততা টলিউড-বলিউডের, তখন হঠাৎ নাবালিয়ার পুজোর মুখ সুব্রত-ভাস্কররা কী বলছেন?
সুব্রতর মন্তব্য, “ফুটবল থিম করে সেখানে যে কলকাতার তিন প্রধানের ঐতিহ্যকে তুলে আনা যায়, তা জানার পরে এই প্রয়াসকে কুর্নিশ জানাতেই হয়।” লাল-হলুদের ঘরের ছেলে ভাস্করের কথায়, “ফুটবল তো কোথাও কোথাও যুদ্ধ থামিয়ে দেয়। অশুভকে বিনাশ করে শুভ শক্তিকে জাগ্রত করে।” ভাস্করের ক্লাব ইস্টবেঙ্গলের সচিব কল্যাণ মজুমদারও বলেন, “ফুটবল নিয়ে পুজোয় ইস্টবেঙ্গলও থিম। যেতে তো হবেই।” মোহনবাগান সচিব অঞ্জন মিত্রের গলাতেও সৌভ্রাতৃত্বের সুর। বললেন, “মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহমেডান তো বাঙালিয়ানার তিন স্তম্ভ। কার্গিল যুদ্ধের সময়েও আমরাই প্রথম সমাজসেবায় এগিয়েছিলাম।” মহমেডানের তরফে মইদুল ইসলাম আবার বলছেন, “যে ক্লাবের হয়ে এত সম্মান পেয়েছি, তার প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়ে আমি গর্বিত।”
তবে ফুটবল মৈত্রীর আবহে রেষারেষি যে একেবারে নেই, তা নয়। পুজোর চেয়ারম্যান রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটকের কথায়, “মোহনবাগান সমর্থক ছিলাম, আছি, থাকবও। এই উন্মাদনাই তো বাঙালিয়ানার শিকড়কে জিইয়ে রেখেছে।”
বড়িশার পুজো। যে এলাকার বাসিন্দা গৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ক্রিকেটের সঙ্গে যিনি এখন ফুটবলের হাতও ধরে ফেলেছেন আইএসএল-এ, তাঁর টিম আটলেটিকো দে কলকাতা দলের মালিকানার সুবাদে। তাঁর দল পুজোয় নেই কেন? সৌহিত্য-অশোকরা বললেন, “দাদার দল আইএসএল জিতুক, তা হলে পরের বছর তা নিয়েই হবে ফুটবল-টু থিম।”