সেই আবাসনের বাইরে পুলিশি প্রহরা। মঙ্গলবার। — নিজস্ব চিত্র
পণ্ডিতিয়া টেরাসে রবিবারের তাণ্ডবের সময়ে লেক থানার পুলিশ যে শুধু সময় মতো পৌঁছয়নি তা-ই নয়, পরিস্থিতি এতটাই আয়ত্তের বাইরে চলে যায় যে, লেক থানার ভারপ্রাপ্ত ওসিকে যোগাযোগ করতে না পেরে কন্ট্রোল রুম বাধ্য হয় বালিগঞ্জ ও গড়িয়াহাট থানার ওসিকে খবর দিতে।
ডিসি (এসইডি) গৌরব শর্মা নিজেই বলেন, ‘‘রবিবার সকালে ঘটনার সময়ে লেক থানার ভারপ্রাপ্ত ওসিকে বারবার ফোন করেও মোবাইলে পাওয়া যায়নি। ঠিক কী কারণে এমন হয়েছে, আমরা খতিয়ে দেখছি। তার পরে প্রয়োজনে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
ওসি প্রসেনজিৎ ভট্টাচার্য ছুটিতে থাকায় অতিরিক্ত ওসি কল্যাণ ভঞ্জ সে দিন ছিলেন লেক থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার। পণ্ডিতিয়া টেরাসের আবাসনে ঢুকে ক্ষিপ্ত জনতা যখন একটার পর একটা গাড়ি ভাঙচুর করছে, লেক থানার ভারপ্রাপ্ত ওসিকে তখন মোবাইলে কোনও ভাবেই ধরা যায়নি। থানার সহকর্মীরা, লালবাজার কন্ট্রোল রুম, এমনকী বিভাগীয় ডেপুটি কমিশনার পর্যন্ত তাঁর মোবাইলে বারবার ফোন করেও যোগাযোগ করতে পারেননি। কল্যাণবাবুর দাবি, তখন তিনি ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে হাওড়ার সালকিয়ায় তাঁর নিজের বাড়িতে ছিলেন এবং আগের রাতে তাঁর মোবাইলে ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে গিয়েছিল।
এখানেই শেষ নয়। খবর পেয়ে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই ওই অফিসার সালকিয়া থেকে ঘটনাস্থলে ছোটেননি। উল্টে তিনি থানা থেকে গাড়ি চেয়ে পাঠান। সেই গাড়ি লেক থানা অর্থাৎ ঢাকুরিয়া থেকে সালকিয়া পৌঁছয়। তাতে চেপে তিনি যতক্ষণে পণ্ডিতিয়া টেরাসে হাজির হন, ততক্ষণে যা তাণ্ডব হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এমনকী, বিশাল পুলিশবাহিনী পৌঁছেছে, ডিসি-র নির্দেশে ছুটিতে থাকা অবস্থায় পৌঁছেছেন লেক থানার ওসি-ও।
পুলিশের চাকরি মানে তো ২৪X৭ কাজ, সে ক্ষেত্রে তিনি মোবাইলে চার্জ দিয়ে ঘুমোতে যাবেন না কেন? কল্যাণবাবুর সাফাই, ‘‘আমরাও তো মানুষ। শনিবারটা ছিল বিশ্বকর্মা পুজোর রাত। আর রবিবার সকাল আটটায় এমন ঘটনা ঘটা তো প্রত্যাশিত নয়, তা-ই না?’’
পণ্ডিতিয়া টেরাসের আক্রান্ত ওই আবাসনের বাসিন্দারা গোড়া থেকেই সময় মতো পুলিশ না পৌঁছনোর অভিযোগ করছেন। লালবাজার সূত্রের খবর, সময় মতো বাহিনী না পৌঁছনোর মূল কারণ হল, স্থানীয় থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি নিজেকে যোগাযোগের বাইরে রেখেছিলেন।
লালবাজার সূত্রে খবর, রবিবার সকাল সওয়া ৮টা নাগাদ ডিসি (এসইডি) লালবাজারে ওসি কন্ট্রোলকে ফোনে জানান, ৩৬-বি পণ্ডিতিয়া টেরাসে গণ্ডগোল হচ্ছে। ওসি ছুটিতে, অথচ অতিরিক্ত ওসিকে তিনি মোবাইলে পাচ্ছেন না। ডিসি জানান, লালবাজার কন্ট্রোল যেন অতিরিক্ত ওসি-র সঙ্গে যোগাযোগ করে অবিলম্বে তাঁকে বাহিনী নিয়ে ওই ঘটনাস্থলে যেতে বলে।
ডিসি ফোন রাখার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ১০০ ডায়ালে ফোন করে ওই আবাসনের বাসিন্দা এক মহিলা জানান, বাইরের কিছু ছেলে পার্কিং এলাকায় ঢুকে গণ্ডগোল করছে, গাড়ি ভাঙচুর শুরু হয়েছে। লালবাজারের কন্ট্রোল থেকে তখন লেক থানার ভারপ্রাপ্ত ওসি-র মোবাইলে ফোন করা হয়। পরপর তিন বার। কিন্তু পাওয়া যায়নি। তখন কন্ট্রোল রুম ঘটনাস্থলের কাছাকাছি রাস্তায় থাকা একাধিক টহলদার গাড়িকে খবর দেয়। কন্ট্রোল রুম খবর দেয় বালিগঞ্জ ও গড়িয়াহাট থানার ওসিকেও।
কিন্তু কলকাতা পুলিশের এক কর্তার বক্তব্য, এলাকায় এমন আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হলে বাইরের পুলিশ নয়, স্থানীয় থানার পুলিশই ঝটপট পরিস্থিতি সামলাতে পারেন। অথচ লেক থানার পুলিশ তখন নড়েইনি। লালবাজারের ওই অফিসারের কথায়, ‘‘বাহিনী কী ভাবে সিদ্ধান্ত নেবে, যেখানে ক্যাপ্টেনই নেই! তাঁদের নির্দেশ দেবে কে?’’ দেরিতে হলেও লেক থানা থেকে একটি মোটর সাইকেলে করে দু’জন পুলিশ গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু ফোনে খবর দিলেও থানার পুলিশ ছিল কিংকর্তব্যবিমূঢ়, নেতৃত্বের অভাবে। লালবাজারের এক কর্তার কথায়, ‘‘এত বড় ঘটনায় কী পদক্ষেপ করা হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওযার ক্ষমতা সাব-ইনস্পেক্টর পদমর্যাদার বহু ডিউটি অফিসারেরই থাকে না।’’
লালবাজার সূত্রের খবর, শেষমেশ সাড়ে আটটারও পরে পুলিশের টহলদার দু’টি গাড়ি পৌঁছয়। ততক্ষণে ভাঙচুর শেষ। লালবাজারের এক অফিসার বলেন, ‘‘অতিরিক্ত তথা ভারপ্রাপ্ত ওসি-র এই গাফিলতি মেনে নেওয়া যায় না। ক্ষিপ্ত জনতা আবাসনে ঢুকে লুঠ আর মহিলাদের উপর অত্যাচার করলে কী হত!’’
যদিও লেক থানার অতিরিক্ত ওসি কল্যাণ ভঞ্জের দাবি, ‘‘শনিবার রাত সাড়ে ১২টায় বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছি। মোবাইলের চার্জ ফুরিয়ে গিয়েছিল। সকালে ঘুম ভাঙলে ফোনে চার্জ দিই। কিছুটা চার্জ হলে ফোন চালু করি। তখনই একটার পর একটা ফোন ঢুকতে শুরু করে।’’ লালবাজার কন্ট্রোল জানিয়েছে, চতুর্থ বারের চেষ্টায় তারা অতিরিক্ত ওসি-র সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে।