Coronavirus

করোনা থেকে কি সুরক্ষিত প্রবীণেরা, উদ্বেগ শহরে

চিকিৎসকেরা ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, প্রবীণ ও শিশুদেরই সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা সব চেয়ে বেশি।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০২০ ০৫:২১
Share:

আশঙ্কা: শহরের এক বৃদ্ধাবাসে ঘেঁষাঘেঁষি করে শোয়ার জায়গা। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

মানিকতলার বাসিন্দা তমাল কাঞ্জিলাল এবং স্নেহা দত্ত কাঞ্জিলাল বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন। স্বামী-স্ত্রীর কেউই এখনও বাড়িতে বসে কাজ করার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হননি। ব্যস্ত সময়ে তাঁরা বেরিয়ে গেলে ফ্ল্যাটে থাকেন শুধু তমালের শয্যাশায়ী মা। তাঁকে দেখভালের জন্য আসেন একটি সংস্থার মাধ্যমে নিযুক্ত এক মহিলা।

Advertisement

এক দুপুরে অফিসের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক চলাকালীন তাঁদের আবাসনের রিসেপশন থেকে লাগাতার ফোন আসতে শুরু করে তমালের নম্বরে। ফোন ধরে তিনি জানতে পারেন, যে মহিলা তাঁর মাকে দেখাশোনা করতে আসেন, তাঁর গায়ের তাপমাত্রা বেশি রয়েছে। রিসেপশনের পরীক্ষায় ধরা পড়েছে। তাঁকে আবাসনে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু মহিলা নাছোড়। বলেই চলেছেন, ‘‘আমি না গেলে মাসিমা একা পারবেন না। ক্যাথিটার বদলাতে হয়, আরও অনেক কাজ আছে!’’ অগত্যা বৈঠক ছেড়েই মায়ের কাছে ছুটতে হয় তমালকে।

বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। করোনাভাইরাস নিয়ে দেশজোড়া আতঙ্কের মধ্যে আপাতত বড়সড় প্রশ্নের মুখে প্রবীণদের নিরাপত্তা। চিকিৎসকেরা ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, প্রবীণ ও শিশুদেরই সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা সব চেয়ে বেশি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও বৃহস্পতিবার জাতীর উদ্দেশ্যে তাঁর বক্তৃতায় ষাটোর্ধ্বদের বাড়ি থেকে বেরোতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু বাড়িতে থাকলেও বয়স্কদের অনেককেই পরিচর্যা পেতে অন্যের উপরে নির্ভর করতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেই ‘কেয়ারগিভার’ বা পরিচর্যাকারীরা বাইরে থেকে আসেন। প্রশ্ন উঠেছে, এই মুহূর্তে তাঁদের সংস্পর্শ বয়স্কদের জন্য কতটা নিরাপদ? বহু প্রবীণ-প্রবীণা আবার শহরের নানা বৃদ্ধাবাসে থাকেন। কোথাও তাঁদের একসঙ্গে একটি ঘরে রাখা হয়। কোথাও ঘর আলাদা হলেও পরিচর্যার জন্য নির্ভর করতে হয় বাইরে থেকে আসা লোকের উপরে।

Advertisement

শুক্রবার শহরের একাধিক বৃদ্ধাবাস ঘুরে দেখা গেল, প্রায় সর্বত্রই বাইরের লোকজনের প্রবেশ অবাধ। সামান্য হ্যান্ড স্যানিটাইজ়ার বা মাস্কেরও ব্যবস্থা রাখা হয়নি। উত্তর কলকাতার ‘ঠিকানা ওল্ড এজ হোম’-এ দেখা গেল, দুপুরে কাজে আসা মহিলা কাজকর্ম শুরু করলেন হাত-মুখ না ধুয়েই। এক বৃদ্ধার জন্য জল-মুড়ির ব্যবস্থা করতে বসে তিনি বললেন, ‘‘আমাদের ও সব লাগে না। শুনেছি, একটা বড় বিল্ডিংয়ে থাকা এক জনের করোনা হয়েছে।’’ পাটুলির ‘আলোর দিশা’ বৃদ্ধাবাসে আবার খোঁজ করতে বাইরে থেকে লোক এসেছে শুনেই বয়স্কদের তুলে মাস্ক পরানো শুরু হল। পঞ্চসায়র এলাকার ‘মা কালী বৃদ্ধাবাস’-এ আবার একটি ঘরে একসঙ্গে থাকছেন চার জন। তাঁদের মধ্যে দু’জনের জ্বর এবং কাশি রয়েছে। পাশের ঘরে একটি তেল চিটচিটে চৌকিতে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে শুয়ে দু’জন। করোনাভাইরাসের কথা শুনেছেন? এক বৃদ্ধা বললেন, ‘‘শুনব না! আমার ছেলে পুলিশ। ওকে বলেছি, নাতি-নাতনিদের নাক-মুখ ভাল করে ঢেকে রাখতে।’’

কিন্তু আপনার মাস্ক কোথায়? বৃদ্ধার উত্তর, ‘‘আমাদের দিন শেষ হয়ে এসেছে। আমাদের জন্য ও সবের ব্যবস্থা কে করে?’’ বৃদ্ধাবাসের মালিক দুর্গা নস্কর বললেন, ‘‘আমরা কেউই বাইরে বেরোই না। তাই মাস্ক, স্যানিটাইজ়ারও লাগে না। ওই বৃদ্ধার কাশি বহুদিনের।’’ বাইরে থেকে যাঁরা কাজ করতে আসেন, তাঁদের জন্য কী করছেন? পাশে দাঁড়ানো কাজের মেয়েকে দেখিয়ে মালিক বললেন, ‘‘ও ছুটি নিয়ে নেবে।’’

প্রায় একই রকম দাবি শহরের একাধিক ‘কেয়ারগিভার’ সংস্থার। তারা জানাচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে কী ভাবে কাজ করতে হবে, সে ব্যাপারে কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। কেউ অসুস্থ বুঝলেই তাঁকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মধ্য কলকাতার কাঁকুড়গাছির এমনই একটি সংস্থার আধিকারিক স্বর্ণাভ মজুমদার বললেন, ‘‘কর্মীদের সব রকম প্রশিক্ষণ দিচ্ছি আমরা। কিন্তু কাজ তো চালাতেই হবে। বহু বয়স্ক মানুষ আমাদের উপরে নির্ভরশীল।’’

কিন্তু কোনও কর্মী তথ্য গোপন করে কাজ করলে?

কলকাতা কমিউনিটি পুলিশের আধিকারিক তথা কলকাতা পুলিশের ‘প্রণাম’ প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত সত্যজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘তথ্য যাতে কেউ গোপন না করেন, সে বিষয়টি প্রতিটি সংস্থাকেই নিশ্চিত করতে হবে। এই ধরনের অভিযোগ পেলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যে প্রবীণেরা পুরোপুরি অন্যের উপরে নির্ভরশীল, তাঁদের পরিবারকে বলব, এই পরিস্থিতিতে বয়স্কদের ব্যাপারে আর একটু দায়িত্বশীল হোন। আর যে বয়স্কেরা এখনও নিজের খেয়াল রাখতে পারেন, তাঁদের অনুরোধ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) সব রকম নির্দেশিকা মেনে চলুন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন