ফাইল চিত্র।
করোনার প্রতিষেধক কোভিশিল্ডের দ্বিতীয় ডোজ় নেওয়ার সপ্তাহখানেক পরে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন প্রৌঢ়। পরে মৃত্যু হয় তাঁর। মৃতের পরিবারের অভিযোগ, মৃত্যুর প্রায় ১৯ ঘণ্টা পরে পুরসভার শববাহী গাড়ি এলেও দেহ শ্মশানে নিয়ে যেতে ১৫০০ টাকা চাওয়া হয়েছে। এর পরে শ্মশানে দেহ সৎকারের জন্য দিতে হয় আরও ২৫০০ টাকা। কোভিডে মৃত্যু হলে এটাই নাকি বর্তমানে সৎকারের অলিখিত ‘প্যাকেজ’!
করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যার নিরিখে হাওড়া এখন রাজ্যের মধ্যে তৃতীয় স্থানে। জেলা স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন, প্রতিষেধক নেওয়ার পরে আক্রান্ত অনেকেই হচ্ছেন, তবে মৃত্যুর ঘটনায় বিস্মিত তাঁরাও। হাওড়ার কদমতলার বদন রায় লেনের বাসিন্দা, ৫৮ বছরের সুজিত হাজরা কোভিশিল্ডের দ্বিতীয় ডোজ় নিয়েছিলেন গত ২৮ এপ্রিল। তাঁর পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, সুজিতবাবু গত কয়েক বছর ধরে ডায়াবিটিসে ভুগছিলেন। তবে খুব সাবধানি ছিলেন তিনি। বাড়ি থেকে পারতপক্ষে বেরোতেন না। তাঁর খুড়তুতো ভাই মলয় হাজরা বললেন, ‘‘২৮ এপ্রিল দ্বিতীয় ডোজ় নেওয়ার পরে ৬ মে দাদার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। সঙ্গে সঙ্গেই ওঁকে রামরাজাতলার কাছে একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ-তে ভর্তি করা হয়।’’ তিনি জানান, গত ৮ মে, শনিবার তাঁর দাদার করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট পজ়িটিভ আসে। এর পরে অবস্থার ক্রমশ অবনতি হতে থাকে তাঁর। গত ১০ মে, সোমবার গভীর রাতে মৃত্যু হয় সুজিতবাবুর। মলয়বাবুর কথায়, ‘‘দ্বিতীয় ডোজ় নেওয়ার পরেও দাদা কী ভাবে করোনায় মারা গেলেন, বুঝতে পারছি না।’’
এ বিষয়ে ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোলজির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শান্তনু ত্রিপাঠী বললেন, ‘‘এটি হয়তো একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এর মাধ্যমে প্রতিষেধকের কার্যকারিতাকে বিচার করা ঠিক হবে না। ওই ব্যক্তি সম্পর্কে আগে বিস্তারিত জানতে হবে। তিনি অন্য কোনও অসুখের জন্য স্টেরয়েড জাতীয় কোনও ওষুধ খেতেন কি না, কিংবা কোমর্বিডিটি ছিল কি না, এ সব না দেখে নিশ্চিত হয়ে কিছু বলা উচিত নয়।’’
শান্তনুবাবু বলেন, ‘‘ওই ব্যক্তি দ্বিতীয় ডোজ় পান ২৮ এপ্রিল। আর কোভিডের উপসর্গ দেখা দেয় ৬ মে। অর্থাৎ, আট দিন পরে। মনে রাখতে হবে, দ্বিতীয় ডোজ় পাওয়ার অন্তত ১৫ দিন পর থেকে শরীরে সেটির কার্যকারিতা (বুস্টিং) শুরু হয়। তাই ওই ব্যক্তি যখন আক্রান্ত হয়েছেন, তখনও তাঁর শরীরে দ্বিতীয় ডোজ় কাজ শুরু করেনি, শুধু প্রথম ডোজ়ের ইমিউনিটিই ছিল।’’ তাঁর মতে, ‘‘১০০ জনকে প্রথম ডোজ় দেওয়া হলে সকলের ক্ষেত্রেই সেটি সমান ভাবে কাজ করবে না। আবার কোনও প্রতিষেধকেরই কার্যকারিতা ১০০ শতাংশ নয়। কিন্তু এ সব ভেবে প্রতিষেধক না নিলে ক্ষতি কিন্তু বেশি।’’
গত সোমবার রাত দেড়টা নাগাদ সুজিতবাবুর মৃত্যু হয়। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত তাঁর দেহ ওই নার্সিংহোমেই পড়ে ছিল। সোমবার রাত থেকে জেলাশাসকের দফতরের কন্ট্রোল রুম, জেলা স্বাস্থ্য দফতরের কন্ট্রোল রুম এবং পুরসভার কন্ট্রোল রুমে বার বার জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি। প্রায় ১৯ ঘণ্টা পরে শববাহী গাড়ি আসে মঙ্গলবার রাত ৮টা নাগাদ।
এর পরেই শুরু হয় হয়রানির দ্বিতীয় পর্যায়। মৃতের পরিবারের অভিযোগ, গাড়ি আসার পরে দেহ নিয়ে যেতে চার হাজার টাকা চাওয়া হয়। বলা হয়, গাড়ির ভাড়া বাবদ ১৫০০ আর সৎকারের জন্য ২৫০০ টাকা দিতেই হবে। এটাই নাকি ‘প্যাকেজ’।
কিন্তু করোনায় মৃতদের দেহ সৎকার করতে তো কোনও টাকা লাগার কথা নয়। জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘পুরসভার দুটো শববাহী গাড়ি এই কাজ করছে। এটা পুরসভাই বলতে পারবে।’’ হাওড়া পুরসভার এক পদস্থ কর্তা বলেন, ‘‘কারও কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথাই নয়। অভিযোগ পেলে নিশ্চয়ই তদন্ত হবে।’’
মলয়বাবু বললেন, ‘‘কোভিডে কারও মৃত্যুর পরে দেহ নিয়ে যে ব্যবসা হচ্ছে, সেই অভিযোগ আমরাও শুনেছিলাম। এ বার হাতেনাতে তার প্রমাণ পেলাম।’’