দুরুদুরু বুকে বসেছিলেন তিন থানার ওসি। আশঙ্কায় ছিলেন, শুক্রবার পুলিশ কমিশনারের ডাকা ক্রাইম কনফারেন্সে তাঁদের তুলোধোনা করবেন সিপি। কারণ তাঁদের কারও এলাকায় দুষ্কৃতীরা গুলি চালিয়েছে। কারও এলাকায় ফ্ল্যাটে রাখা বোমা ফেটেছে। ওই সব ঘটনার আগাম কোনও আঁচই পায়নি ওই তিন থানা। কিন্তু কনফারেন্স শেষে হাসিমুখেই লালবাজার থেকে বেরোতে দেখা গেল পার্ক স্ট্রিট, এন্টালি এবং তিলজলা থানার ওই ওসিদের। কনফারেন্সে সিপি ওই সব সমস্যার ধারকাছ দিয়েই যাননি যে!
এন্টালি থানা এলাকায় বুধবারই গুলি চলেছে। বৃহস্পতিবার রাতে গুলি চলেছে পার্ক স্ট্রিটের কলিন লেনে। রবিবার তিলজলা থানা এলাকার একটি ফ্ল্যাটের মধ্যেই মজুত বোমা ফেটেছে। ওই তিনটি ঘটনাতেই শহরের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল। ফ্ল্যাটে বোমা মজুতের খবর কেন পুলিশ আগে পেল না, এমন প্রশ্ন তুলেছিল লালবাজারও। কিন্তু শুক্রবারের ক্রাইম কনফারেন্সে সে রকম কোনও প্রসঙ্গই উঠল না বলে পুলিশ সূত্রের খবর।
অধস্তন পুলিশকর্মীদের আশা ছিল, গত ১৬ মে এনআরএস হাসপাতালে জুনিয়র ডাক্তারদের হাতে এক মহিলা কর্মী-সহ বেশ কিছু পুলিশকর্মীর নিগ্রহের ঘটনায় কেন লালবাজার হাত গুটিয়ে রয়েছে, তার ব্যাখ্যা দেবেন পুলিশ কমিশনার। বিভাগীয় ডিসি-কে প্রশ্ন করবেন। কিন্তু তা হল না। গত ২২ মে রাতে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে মেয়রের ভাইঝি-র হাতে পুলিশ নিগ্রহের অভিযোগ নিয়েও কোনও আলোচনায় যাননি পুলিশ কমিশনার। ওই ঘটনাটি নিয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রী সরব হওয়ার পরে থানার ওসি-দের অনেকেরই ধারণা হয়েছিল এ দিন ক্রাইম কনফারেন্সে পুলিশ কমিশনার নিজে বিষয়টি উত্থাপন করবেন। কিন্তু লালবাজার সূত্রের খবর, এনআরএস ও রাসবিহারী-কাণ্ড এ দিন এড়িয়ে গিয়েছেন পুলিশ কমিশনার।
ক্রাইম কনফারেন্সে উপস্থিত থাকা এক ওসি-র মন্তব্য, ‘‘আমরা দেড় ঘণ্টার বৈঠকে পুলিশ কমিশনারের মুখ থেকে এক বারের জন্যও বিভিন্ন পুলিশ নিগ্রহের অভিযুক্তেরা কেন ধরা পড়ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন শুনলাম না। রাসবিহারী-কাণ্ডে ডিউটিরত ট্রাফিক কনস্টেবল চন্দন পাণ্ডের ভূমিকা ঠিক না ভুল ছিল, সেটাও পরিষ্কার করলেন না আমাদের বাহিনীর প্রধান।’’
শুধু রাসবিহারীর ট্রাফিক কনস্টেবল চন্দন পাণ্ডে ঘটনার দুই দিন পর থেকে ছুটিতে কেন চলে গেলেন, তা সিপি জানতে চান বলে লালবাজার সূত্রের খবর। সূত্রের খবর, এ দিন বৈঠক চলাকালীন সিপি এক যুগ্ম কমিশনারের কাছে জানতে চান, টালিগঞ্জ ট্রাফিক গার্ডের কনস্টেবল চন্দন পাণ্ডের ছুটি নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে কেন? তাঁর ছুটি কবে মঞ্জুর করা হয়েছিল? ওই যুগ্ম কমিশনার সিপিকে জানান, ওই কনস্টেবল চলতি মাসের শুরুতেই ছুটির আবেদন করেছিলেন। পরে ডেপুটি কমিশনার (ট্রাফিক) তা মঞ্জুর করেন। ছুটি কাটাতে ওই কনস্টেবল কাশ্মীরে গিয়েছেন।
কিন্তু সাম্প্রতিক গুলিচালনা ও বোমা বিস্ফোরণের মতো ঘটনাগুলি নিয়ে এ দিনের ক্রাইম কনফারেন্সে পুলিশ কমিশনার কেন সরব হলেন না? পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ ফোন ধরেননি। এসএমএস-এরও জবাব দেননি। লালবাজারের এক শীর্ষকর্তার অবশ্য ব্যাখ্যা, এ বারের বৈঠকে আলোচনার বিষয় ছিল এপ্রিল মাসে শহরে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অপরাধের বিশ্লেষণ করা। কিন্তু উল্লিখিত ঘটনাগুলি মে মাসে ঘটেছে। যদিও কলকাতা পুলিশে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করা একাধিক আইপিএস অফিসার জানাচ্ছেন, ‘‘ক্রাইম কনফারেন্সে এ রকম একটা প্রথা থাকলেও, সব সময়েই সাম্প্রতিক কোনও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে ক্রাইম কনফারেন্সে তা নিয়ে অবশ্যই আলোচনা হতে পারে। এ রকম অনেক নিদর্শন রয়েছে।’’
লালবাজারের সূত্রটির খবর, এপ্রিল মাসের অপরাধ নিয়ে আলোচনার কথা থাকলেও ১৮ এপ্রিল কলকাতা পুর-ভোটের দিন ভোট শেষে গোলমাল থামাতে গিরিশ পার্ক থানার অফিসার জগন্নাথ মণ্ডলের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার প্রসঙ্গই এ দিনের বৈঠকে ওঠেনি। ১৪ এপ্রিল তৃণমূল নেতা প্রতাপ সাহার হাতে নিগৃহীত হতে হয়েছিল খোদ আলিপুর থানার ওসিকে। সে বিষয়েও নীরব ছিলেন কমিশনার।
লালবাজার সূত্রের খবর, এ দিনের বৈঠকে বড়বাজারের একটি খুনের ঘটনার কিনারা না হওয়াতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন সিপি। তিনি গোয়েন্দা বিভাগের হোমিসাইড শাখাকে এ ব্যাপারে তৎপর হতে বলেন। পাশাপাশি, প্রতিটি থানার অফিসারদের অপরাধ দমনে জোর দিতে বলেন। এক পুলিশ অফিসার পরে বলেন, ‘‘কমিশনার বলেছেন, এখন সামনে ঘোষিত বড় কোনও অনুষ্ঠান নেই। তাই অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে আরও সক্রিয় হতে হবে।’’ লালবাজারের এক কর্তা বলেন, ‘‘বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারায় তিনটি ডিভিশনের প্রতি ক্ষোভ দেখিয়েছেন কমিশনার।’’
কলকাতা পুলিশে দীর্ঘ দিন ওসি এবং এসি পদে কাটিয়ে যাওয়া এক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার বলেন, “আমরা দেখেছি, কমিশনার অনেক সময়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপন করতে ভুলে গেলে অন্য পদস্থ কর্তারা তাঁকে তা মনে করিয়ে দিতেন।’’ তাই অধস্তন পুলিশকর্মীদের অভিযোগ, ইচ্ছে করেই পুলিশ কমিশনার ও তাঁর অনুগত লালবাজার কর্তারা কেই বির্তকিত বিষয় অলোচনাতেই তোলেননি এ দিন।