ঠেকুয়ার স্বাদে-গন্ধে উজ্জ্বল ছট

খেয়াল রেখো, ওই দাঁতভাঙা ঠেকুয়া যেন না হয়! তত দিনে ঘরে মজুত হয়ে গিয়েছে ডিবে ভরপুর খাঁটি গাওয়া ঘি, আটা, ময়দা, গুড়। মণ্ড পাকিয়ে বাদাম-কিসমিসবাটা, এলাচগুঁড়োর ছোঁয়ায় রাশি-রাশি ‘দেশি বিস্কুট’ গড়ার যজ্ঞি তখনই শুরু।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৭ ০১:৫৯
Share:

নৈবেদ্য: চলছে ছটপুজোর প্রস্তুতি। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

কালীপুজোর দিন সাতেক আগে থেকেই প্রয়াত স্বামী কপিলদেও দ্বিবেদীর কথাগুলো কানে বাজে মালতীদেবীর।

Advertisement

খেয়াল রেখো, ওই দাঁতভাঙা ঠেকুয়া যেন না হয়! তত দিনে ঘরে মজুত হয়ে গিয়েছে ডিবে ভরপুর খাঁটি গাওয়া ঘি, আটা, ময়দা, গুড়। মণ্ড পাকিয়ে বাদাম-কিসমিসবাটা, এলাচগুঁড়োর ছোঁয়ায় রাশি-রাশি ‘দেশি বিস্কুট’ গড়ার যজ্ঞি তখনই শুরু। আমিষের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে শুদ্ধাচারে ফিকে লাল ঠেকুয়া ভাজার সুগন্ধেই বাড়িতে ছটের পার্বণী ছোঁয়া।

কর্তার পছন্দমাফিক ঠেকুয়া হবে মজবুত, কিন্তু দন্তোপযোগী। কামড়ের পরই হালকা মিষ্টি স্বাদটা মুখে মিলিয়ে যায়। এই খাস্তা নরমের রহস্য কোথায়?

Advertisement

বারবার জিজ্ঞেস করতে হেসে ফেললেন সত্তর ছুঁই-ছুঁই বৃদ্ধা। ‘‘এ বাড়ির ঠেকুয়ায় এক ফোঁটা জল পড়ে না। শুধু দুধ মেশানোই দস্তুর।’’ ছটের শেষ দিন রাত জেগে গঙ্গায় প্রভাতি অর্ঘ্য দান, দেড়দিনের উপোসের পরও আশ্চর্য উজ্জ্বল মালতীদেবীর চোখমুখ। আগে টালায় কৃপানাথ দত্ত রোডের পড়শিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত ছটপুজোর প্রসাদি ঠেকুয়া বিলি। কপিল-মালতীর তিন ছেলের সৌজন্যে এখন তা কলকাতাময় ছড়িয়ে পড়েছে।

দুই ছেলের প্লাস্টিক কারখানার পারিবারিক ব্যবসা, মেজো জন ইন্সপেক্টর কুসুমকুমার মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অফিসার। ঠেকুয়ার পরিমাণ বাড়লেও স্বাদের উৎকর্ষে ভাটা পড়ে না। টবিন রোডে দ্বিবেদীদের এখনকার বাড়ি থেকে বচ্ছরকার ছটের প্রসাদ বহু মান্যগণ্যের কাছেই পৌঁছে গিয়েছে।

তবে ছটের পার্বণী হাওয়ায় টালায় পুরনো পড়শিদের জন্যই মন পড়ে থাকে মালতীদেবীর। কন্যাসম শিবানী ঘোষের ফোনটা আসতেই চোখেমুখে আলো! ওর দিদির পরে ফের মেয়ে জন্মানোয় খানিক মুখভার হয়েছিল শিবানীর বাবার। মেয়েটা তখন দ্বিবেদীদের ঘরে মালতীর কোলেই প়ড়ে থাকত। টালায় সর্বজনীন ‘ভাবি-মা’ মালতী। পাড়ায় একমাত্র বিহারী পরিবার ওঁরাই। বাঙালি দিদি-বউদিদের থেকে শেখা কচুর লতি, ইলিশ ভাপা, মুড়ি ঘণ্টয় ক্রমশ দুরস্ত হয়ে উঠেছেন মালতী। আবার কাশীপুরে সর্বমঙ্গলা ঘাটে ছটের অর্ঘ্য নিয়ে যাওয়ার সময় বাঙালি পড়শিরাও চলতেন পায়ে-পায়ে। ছটের শেষ দিন, দীপাবলির পরের সপ্তমীতে দ্বিবেদীদের বাড়ির লুচি-তরকারি-ঠেকুয়ার লোভে এখনও দল বেঁধে আসেন তাঁরা।

ছট প্রধানত মেয়েদের ব্রত। ছটি মাইয়া নাকি সূর্যের বোন কিংবা বেদের উষাদেবী। তাঁর অর্চনা বলতে মেয়েদের তিন দিন ধরে শুদ্ধাচারে উপোস। কুলোয় রকমারি ফল, ঠেকুয়ার অর্ঘ্য সাজিয়ে কোমরজলে সূর্যপ্রণাম। বিহারে সিওয়ানের বিষুনপুরা গাঁয়ে ১৯ বছরে বড় ছেলে হওয়ার পর থেকেই ছট রাখছেন মালতীদেবী। উপোসের ফাঁকে নুনহীন রুটি, অড়হর ডাল, লাউয়ের তরকারি, ছোলা-কাঁচকলা খাওয়ার রেওয়াজ। গুড়-চালের অভিনব শুকনো পায়েসে পরে গরম দুধ মিশিয়ে খেতে হয়। এ সব সুখাদ্যের সূত্রে বাঙালি পড়শিদের সঙ্গে সংযোগেও বেজে ওঠে ঐক্যের সুর। এখন গঙ্গার ঘাটের পথে পুণ্যার্থীদের পরিচর্যায় বসা ক্লাবের ছেলেদের ভিড়ে বহু বাঙালি মুখও মিশে যাচ্ছে। কোনও কোনও বাঙালি বউও শামিল হচ্ছেন বিহারীদের পার্বণে। গঙ্গায় অর্ঘ্য দান করে বিজয়ার সিঁদুরখেলার আদলেই তাঁরাও হইহই করে মাখছেন গেরুয়ারঙা মেটে সিঁদুর।

মালতীর নাতনি মিশনারি স্কুলের ক্লাস এইটের ছাত্রী। তাঁর ক্লাসের বাঙালি বন্ধুর ঠাকুমাও ফোন করেছিলেন কয়েক দিন আগে। দিদি একটু দেখবেন, আমার অসুস্থ স্বামীর নামে মনে করে এক বার ছটি মাইয়ার কাছে পুজো দিতে ভুলবেন না!

কলকাতার গঙ্গার ঘাটেও ইতিউতি চোখে পড়ে ছটি মাইয়ার থান।
কিছুটা শিবলিঙ্গের সঙ্গে মিল আছে। মাটির পিরামিডের আদল। সাজানো শহুরে নদীতটে এ ভাবেই জেগে থাকে প্রাচীন পরম্পরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন