জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে মাধুরী বৈদ্যের।
জুন-জুলাই মাস থেকেই নিউ টাউনের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রমোদগড়ে জ্বরের দাপট শুরু হয়েছিল। মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছিল। পাঁচ মাসের মাথাতেও বদলাল না সেই ছবিটা। প্রমোদগড় এলাকাতেই এ বার জ্বরে মৃত্যু হল পুর স্বাস্থ্যকর্মী মাধুরী বৈদ্যের (৪১)। বুধবার দুপুরের সেই মৃত্যুর শংসাপত্রে অবশ্য লেখা হয়েছে, হৃদ্যন্ত্র বিকল হয়েছিল মহিলার। তবে পরিবারের দাবি, জ্বর, পেটে ব্যথা, বমি, খিঁচুনি হয়েছিল তাঁর। যে সব কি না ডেঙ্গির উপসর্গ হিসেবেই দেখছেন চিকিৎসকেরা।
এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, ওই ওয়ার্ডে মশা নিয়ন্ত্রণে পুরসভা ব্যর্থ। এলাকায় ব্লিচিং ছড়ানো থেকে শুরু করে জঞ্জাল পরিষ্কার, কোনও কিছুই নিয়মিত হয় না। বিশেষত কাউন্সিলরের কোনও তৎপরতা চোখে পড়ে না বলেই অভিযোগ ক্ষুব্ধ বাসিন্দাদের। অন্য দিকে পুরসভার আধিকারিকদের দাবি, এই ওয়ার্ডে বিধাননগর পুরসভা দু’বার মেডিক্যাল ক্যাম্পও বসিয়েছে। এলাকার মানুষদের সচেতনতার অভাবেই মশাবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়ছে।
ডেথ সার্টিফিকেটে অবশ্য জ্বরের কোনও উল্লেখ নেই।
পুরসভা ও সাধারণ মানুষদের একে অপরকে এই দোষারোপের পালার মধ্যেই অব্যাহত এলাকায় ডেঙ্গিতে মৃত্যুর ঘটনা। মাধুরীদেবীর পরিবার সূত্রে খবর, শনিবার থেকে তাঁর জ্বর এসেছিল। সঙ্গে পেটে ও পিঠে অসহ্য যন্ত্রণা। বমিও হচ্ছিল। মাধুরীদেবীর স্বামী দেবদাসবাবু জমি-বাড়ির দালালি করেন। তাঁদের দুই ছেলে আছে। দেবদাসবাবু জানান, সোমবার তাঁরা মাধুরীদেবীকে দেশবন্ধুনগর হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে ওষুধ দেওয়া হয় এবং রক্তপরীক্ষা করতে বলা হয়। যদিও দেবদাসবাবুর দাবি, মঙ্গলবার সকালে করা রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট আসেনি। দুপুরে অবস্থার অবনতি হলে এক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় মাধুরীদেবীকে। তিনি হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। স্থানীয় এক চিকিৎসক এসে ডেথ সার্টিফিকেট দিয়েছেন। তাতে মশাবাহিত কোনও রোগের উল্লেখ নেই।
কিন্তু ওই এলাকায় এত ডেঙ্গির প্রকোপ কেন? পুরসভার একাংশের দাবি, বাম আমল থেকে এই এলাকায় ক্রমশ বসতি বেড়েছে। কিন্তু নিকাশি পরিকাঠামো তৈরি হয়নি। নিকাশি খালের উপরেই বসতি গড়ে উঠেছে। এটি যেমন সমস্যার একটি মুখ, তেমনই সচেতনতার চূড়ান্ত অভাব অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন তাঁরা। সময়ে চিকিৎসকের কাছে না যাওয়ার প্রবণতা, সূঁচ ফোটানোর ভীতি, জল জমিয়ে রাখার অভ্যাস, জলের পাত্র খোলা রাখা-সহ একাধিক প্রবণতাও দায়ী বলে মনে করছেন পুরকর্মীরা। অন্য দিকে ওই এলাকার বাসিন্দাদের দাবি, পুরসভা নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ। তাই তাদের এলাকায় ডেঙ্গির প্রকোপ কিছুতেই কমছে না। স্থানীয় যুবক সঞ্জয় বিশ্বাস বলেন, ‘‘মাধুরীদেবীর মৃত্যুর ঘটনার পরে হয়তো কয়েক দিন মশা মারার তেল ছড়ানো হবে, কিন্তু কয়েক দিন পরে পরিস্থিতি হবে যে কে সেই। জঞ্জাল উপচে পড়ছে নর্দমায়। অথচ কাউন্সিলরকে এলাকায় দেখাই যায় না।’’ যদিও এলাকার কাউন্সিলর চামেলি নষ্করের দাবি, ‘‘আমি মাঝেমধ্যেই ওই এলাকায় মানুষকে সচেতন করতে যাই। এলাকার প্রতিটি গলিতে ব্লিচিং এবং মশার তেল ছড়ানো হচ্ছে। বারবার এলাকার মানুষকে বলেছি, জ্বর হলেই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। শুনেছি মাধুরীর পরিবারও ঠিক সময়ে ওঁকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায়নি।’’
ওই অঞ্চলে শুধু প্রমোদগড়-জ্যোতিনগর নয়, ২০, ২১, ২২, ২৫, ২৮ নম্বর-সহ বিধাননগর পুরসভার একাধিক ওয়ার্ডে এ বার মশাবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়েছে। এর একটি মূল কারণ পরিকাঠামোগত সমস্যা বলেও মনে করে পুর প্রশাসনের একটি অংশ। বরো চেয়ারম্যান বাণীব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বাম আমল থেকে খাস জমিতে পরিকল্পনা ছাড়াই বসতি গড়ে তোলা হয়েছে। ভেড়ি, খাল, নিকাশি নালার উপরে বাঁশ পুতে বাড়ি বানানোর খেসারত দিতে হচ্ছে। তা সত্ত্বেও দায়িত্ব নেওয়ার পরে বর্তমান পুরবোর্ড পরিকাঠামো তৈরির কাজে হাত দিয়েছে। কিন্তু তা সময় এবং ব্যয়স্বাপেক্ষ।’’ অন্য দিকে মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) প্রণয় রায় বলেন, ‘‘ওই ধরনের অনুন্নত এলাকায় সচেতনতার প্রচারে সে ভাবে সাড়া মেলেনি। মশারি ব্যবহার না করা থেকে শুরু করে জলের পাত্র ঢেকে না রাখার প্রবণতায় সমস্যা বাড়ছে। তবে পুরসভা সাধ্যমত চেষ্টা করছে।’’
—নিজস্ব চিত্র।