Coronavirus Lockdown

ধর্মের ভেদাভেদ মুছে দিল দুঃখ দিনের ইদ

মোমিনপুরের চার বাতি মোড়ের কাছে সলমা বিবির মতো অনেকেরই এই ইদে ঘরদোর জল থইথই।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০২০ ০৩:৩২
Share:

বিকিকিনি: ইদের আগে ফল কেনাকাটা। রবিবার, চাঁদনি চকে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

ইদের দাওয়াত, কোলাকুলির অনুষঙ্গ সে ভাবে দানা বাঁধেনি তাঁদের জীবনে। আধো চেনা পার্বণের খুঁটিনাটি বোঝাবুঝিতে ফাঁক থেকে গিয়েছে।

Advertisement

কোভিড অতিমারি এবং আমপানের অত্যাচারে ধ্বস্ত দিনে সেই ইদই অন্য অর্থ বহন করছে কারও কাছে। ভবানীপুরের বাসিন্দা কর্পোরেট কর্ত্রী শর্মি রায়চৌধুরী, সল্টলেকের বাসিন্দা ইতিহাস-শিক্ষিকা অন্বেষা সেনগুপ্তেরা অনেকেই এই ইদের শরিক হতে বাড়তি তাগিদ অনুভব করছেন। খিদিরপুরের গভর্নমেন্ট গার্লস জেনারেল ডিগ্রি কলেজে ইংরেজির শিক্ষিকা অন্তরা মুখোপাধ্যায়ও লকডাউনে চন্দননগরের বাড়িতে গোটা রমজান মাস তাঁর ছাত্রী বা কলেজের শিক্ষাকর্মীদের অভাব অনুভব করেছেন। দুঃখের দিনের উৎসবে চেনা-অচেনাদের পাশে দাঁড়াতে তাঁরা অনেকেই এ বার এগিয়ে এসেছেন।

মোমিনপুরের চার বাতি মোড়ের কাছে সলমা বিবির মতো অনেকেরই এই ইদে ঘরদোর জল থইথই। পার্ক সার্কাসের রেলবস্তির ধারে মুমতাজ সর্দারের মতো কেউ আবার ঘূর্ণিঝড়ে উড়ে যাওয়া ঝুপড়ির প্লাস্টিক কুড়িয়ে এনে নতুন করে ঘরটুকু বাঁধতে পেরেছেন। রোজা উপলক্ষে তা-ও এক বেলা কম খেয়ে অনেকের চলে যাচ্ছিল। এই ইদে নতুন পোশাক, সিমুই ছাপিয়ে কয়েক দিনের চাল-ডালের রেশনই ঢের বড় অবলম্বন। রবিবার, প্রাক-ইদ চাঁদ রাতের ঠিক আগে তাঁদের কারও কারও জন্য খড়কুটোর সাহায্য এসেছে। শর্মি, অন্বেষা, অন্তরার মতো কারও কারও বিক্ষিপ্ত অনুভবের ছোঁয়াচেই সেজে উঠছে অসহায়, গরিবগুর্বোর ইদের খুশি।

Advertisement

আরও পড়ুন: দু’মাস পরে খুলছে বইপাড়া

শর্মি বলছিলেন, ‘‘আমার কাছে ইদ বলতে এত দিন কাবাব-বিরিয়ানি বা নিউ মার্কেটের রঙিন চুড়ির বেশি কিছু ছিল না। কিন্তু ইদানীং দেশে বৈষম্যের আবহে ভ্রাতৃত্ববোধের টানেও ইদ অন্য মানে পাচ্ছে।’’ কর্পোরেট-কর্ত্রী শর্মির মনে হয়েছে, লকডাউনের বাজারে অফিস যাতায়াতের ঝক্কি নেই। তাই উল্টে কিছুটা খরচ বাঁচছে। এ বছর আরও বেশি করে মানুষের পাশে থাকা উচিত। ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ়ের ইতিহাসের শিক্ষিকা অন্বেষার পর্যবেক্ষণ, ‘‘কলকাতা শহরেও মুসলিমরা কয়েকটি পাড়াতেই বিচ্ছিন্ন। গড়পড়তা হিন্দু বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণির বৃত্তে মুসলিমদের উৎসব-সংস্কৃতি সম্বন্ধে জানার সুযোগ বরাবরই কম!’’ এই বিষয়গুলি নিয়ে ভাবতে ভাবতেই এ বছরের ইদে পাশে থাকার ইচ্ছেটুকু তাঁকে পেয়ে বসেছিল। খিদিরপুরের কলেজশিক্ষিকা, চন্দননগরের অন্তরার কাছেও খিদিরপুর এখন নিজের পাড়া হয়ে উঠেছে। ‘‘এত দুঃখ-সঙ্কটে এই ইদটা সত্যিই আলাদা।’’— বলছিলেন তিনি।

এন্টালি, পার্ক সার্কাস, মোমিনপুর, খিদিরপুর, ট্যাংরা, বেলগাছিয়ার মতো কয়েকটি পাড়ায় সক্রিয়, পড়শিকে জানার একটি সম্প্রীতি-মঞ্চের স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমেই হতদরিদ্র ঘরের কয়েক জনকে খুঁজে বার করা হয়েছে। ট্যাংরার বাসিন্দা, বিমা সংস্থার কর্মী মহম্মদ আনোয়ার বলছিলেন, ‘‘সংখ্যাটা বেশি নয়। চেনাজানা কয়েক জনের মাধ্যমে কম-বেশি ৩৫০টি পরিবারকে বেছে নিয়েছি।’’ মাসখানেক চলার মতো চাল, ডাল, তেল, সয়াবিন, সাবান, স্যানিটারি ন্যাপকিনের সঙ্গে কিছুটা সিমুই, লাচ্চা, ময়দা, ডালডা, চিনি এ বার তুলে দেওয়া হচ্ছে। আনোয়ারের নিজের কাছেও ইদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো হল এক ধরনের ধর্মাচরণ জ়াকাত বা ফিতরার অঙ্গ। অমুসলিম দরিদ্রদেরও তাঁরা ইদ উপলক্ষে সাহায্য করছেন। ভিন রাজ্যে ‘বন্দি’ শ্রমিকেরা আসতে না-পারায় বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রামের বাড়িতেও ইদে খুশির আলো জ্বলবে না। সাধ্যমতো তাঁদের পাশে রয়েছে ‘মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স সলিডারিটি’ বা ‘বঙ্গ সংস্কৃতি মঞ্চ’-এর মতো জোটবদ্ধ সংহতির প্রকাশ।

মোমিনপুরে জল-বন্দি ঘরে সলমা ভেবে পাচ্ছিলেন না, চিনি-ময়দা সব কোথায় রাখবেন। দুঃখ দিনের ইদে ছেলেমেয়েদের নাকে সিমুই-সুরভিটুকু পৌঁছবে ভেবে তবু খানিক স্বস্তিতে তিনি।

আরও পড়ুন: করোনায় আক্রান্ত প্রাক্তন কাউন্সিলর

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন