তেচোখা মাছ।
এ যেন ‘বহিরাগতে’র সাম্রাজ্য বিস্তার! দ্রুত প্রজনন করে নিজের সাম্রাজ্য বাড়ানো, ক্রমশ এ দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া। তার পরে ডেঙ্গির জীবাণু বহনকারী মশা এডিস ইজিপ্টাইয়ের প্রধান শত্রু ও মানুষের বন্ধু হয়ে ওঠা। কিন্তু ডেঙ্গি নিধনে ‘বহিরাগত’ সেই বন্ধু, গাপ্পি মাছের একাধিপত্ব কি খর্ব হওয়ার মুখে? এমনই জল্পনা শুরু হয়েছে পতঙ্গবিদদের একাংশের মধ্যে।
জল্পনার কারণ, নিউ টাউনের জলাশয়গুলিতে ডেঙ্গি প্রতিরোধে তেচোখা মাছের ব্যবহার। এডিসের লার্ভা নিধনের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম প্রচারে থাকা এই মাছের ‘পারফর্ম্যান্স’ই ভাবাচ্ছে পতঙ্গবিদদের একাংশকে। নিউ টাউনের জলাশয়ে তেচোখা মাছের লার্ভা নিধনের যে সমীক্ষা-রিপোর্ট দেখা যাচ্ছে, তাতে আরও বেশি করে একে ব্যবহার করা যায় কি না, সেই প্রশ্ন তুলছেন পতঙ্গবিদদের একাংশ। কারণ, তেচোখা মাছ দেশীয়। ফলে ‘বহিরাগত বন্ধু’ না ‘ঘরের ছেলে’, কে হবে ডেঙ্গি দমনের প্রধান কাণ্ডারি, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
পতঙ্গবিদদের একাংশ জানাচ্ছেন, গাপ্পি প্রধানত দক্ষিণ আমেরিকার প্রজাতি। এই মাছের ইতিহাস দীর্ঘ ১০০ বছরের। ওখানে ওদের মূল উৎস হলেও দ্রুত তারা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে। অন্য দেশের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে বংশবিস্তারও করেছে। ভারতে প্রথম ওই মাছ আসে ১৯১০ সাল নাগাদ। ক্রমেই ডেঙ্গি নিধনের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে গাপ্পি। কলকাতা পুরসভা-সহ পার্শ্ববর্তী পুরসভাগুলি মশার লার্ভা নিধনের ক্ষেত্রে সব সময়েই গাপ্পির প্রচার করে।
এর অন্যতম কারণ হিসেবে পতঙ্গবিদেরা জানাচ্ছেন, ছোট জলাধারে দ্রুত বংশবিস্তারের ক্ষেত্রে গাপ্পির তুলনা নেই। এমনকি, ছোট চৌবাচ্চাতেও এরা সহজে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পারে। এডিস মশা যেহেতু ছোট জলাধার বা পাত্রেই ডিম পাড়ে, তাই লার্ভা নিধনে গাপ্পির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
কিন্তু নিউ টাউনে তেচোখা মাছের সাফল্যে অন্য বিষয় ভাবছেন পতঙ্গবিদেরা। নিউ টাউন-কলকাতা ডেভেলপমেন্ট অথরিটি ও নবদিগন্তের মুখ্য পরামর্শদাতা তথা পতঙ্গবিদ গৌতম চন্দ্র বলেন, ‘‘নিউ টাউনের জলাশয়গুলিতে এমনিই তেচোখা মাছ রয়েছে। যে জায়গাগুলিতে নেই, সেই পাঁচ ফুটের কম গভীর জলাশয়গুলিতে আমরা তেচোখা ছেড়েছি। ভাল ফল মিলেছে। আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, ডেঙ্গি নিধনে তেচোখা আরও বেশি ব্যবহার করা উচিত। কারণ, দেশীয় এই মাছের ব্যবহার যত হবে, তত পরিবেশগত দিক থেকে ভাল।’’
এমনিতে গাপ্পি, তেচোখা ছাড়াও গাম্বুশিয়া ও তেলাপিয়া মাছও মশার লার্ভা খায়। কিন্তু গাম্বুশিয়ার সমস্যা হল, তারা বংশবিস্তারে বেশি জায়গা নেয়। ছোট জায়গা হলে বংশবিস্তারের হার কমে যায়। তেলাপিয়ার সমস্যা, তারা অন্য মাছ খায়। আবার সাধারণ মানুষও তেলাপিয়া খান। ফলে কোনও জলাধারে তেলাপিয়া ছেড়ে মশা নিধন করা সমস্যার বিষয় বলেই মনে করছেন পতঙ্গবিদেরা। কিন্তু তেচোখা মাছের সেই সমস্যা নেই।
মশা-গবেষক ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘দেশীয় মাছের ব্যবহার
সব সময়েই ভাল। তেচোখার ব্যবহারও ধীরে ধীরে বাড়ানো উচিত।’’ আর এক মশা গবেষক অনুপম ঘোষ বলেন, ‘‘গাপ্পির ব্যবহার সারা বিশ্বেই রয়েছে। ফলে প্রচারে এগিয়ে তারাই। কিন্তু তেচোখা মাছও যে ডেঙ্গি প্রতিরোধে একই রকম কার্যকর, তা ইতিমধ্যেই পরীক্ষিত। কিন্তু দেশীয় মাছ হওয়ায় সেটি
নিয়ে তুলনামূলক ভাবে কম প্রচার হয়েছে। জীববৈচিত্রের কথা মাথায় রেখে কিন্তু তেচোখো মাছের ব্যবহারই বাড়ানো দরকার।’’