শহরের ভোজনরসিকদের জন্য রয়েছে এমনই সব পদ।
মাঝেরহাট সেতুভঙ্গের দিনেই কার্যত নিঃশব্দে উত্তর কলকাতায় গুঁড়িয়ে গিয়েছিল শহরের এক অন্য ঐতিহ্য। মালিকানা নিয়ে মামলার জেরে শ্রীমানি মার্কেটের কপিলাশ্রমের সরবতের দোকানটি সে দিন পুলিশ পাহারায় ধূলিসাৎ করে দেওয়া হয়।
কপিলাশ্রমের কর্তা দিব্যেন্দু শ্রীমানি এখন সেই ফুটপাতে ছাতা পেতে হকার বনে নতুন বছরের কেক বিক্রি করছেন। শহরের সাবেক সসেজ-কোল্ডকাটের তীর্থস্থান কালম্যানও শোনা যাচ্ছে, কারিগরের আকালে কাবু। কর্মীরা অনেকেই বিকল্প জীবিকার খোঁজে জল মাপছেন। কলকাতার ভোজ-রসিকদের জন্য ২০১৯-এর আবাহনের মধ্যে তাই মিশে রয়েছে কিছু দীর্ঘশ্বাস ও আশঙ্কা।
তা বলে নতুনের হাতছানিও কম পড়ছে না। পশ্চিমী শৈলীর নানা কিসিমের ঠান্ডা মাংসের কেতায় নাগরিক-জীবন মাত করতে শহরে হাজির কয়েকটি সর্বভারতীয় সংস্থা। সুপার মার্কেটের নানা কিসিমের সস, চিজ় বা হার্বের বৈচিত্র্যেও এক ছাদের নীচে গোটা বিশ্ব ধরা দিচ্ছে। দক্ষিণ-পুব এশিয়ার ফিশ সস, ডাচ চিজ় বা পার্মা হ্যাম— হাতের মুঠোয় চলে আসাটা তা বলে পুরোপুরি ভালও জোর গলায় বলা যাচ্ছে কই! নেটরাজ্য সবার রান্না এক ছাঁচে ঢালাইয়ের বিপদও বিলক্ষণ মালুম হচ্ছে।
গোয়া এবং মুম্বইয়ে বাঙালি রান্নার রেস্তরাঁ মাস্টার্ড-এর কর্ত্রী পৃথা সেন কিন্তু এই বিশ্বায়নের যুগেও বৈচিত্র্যের ফুলই দেখছেন। তাঁর দাবি, ‘‘২০১৮-এ দেশের বড় শহরগুলিতে নানা রকমের আঞ্চলিক খানার প্রতি ঝোঁক বেড়েছে। ২০১৯-এ আরও ছোট-ছোট পরিসরে মাইক্রো রিজিয়োনাল কুইজ়িন রাজত্ব করবে।’’ গত পুজোয় ঢাকার বধূ কলকাতাকন্যা নয়না আফরোজ়কে মুম্বইয়ে টেনে এনে ভর্তা-তেহরি-পোলাও-ঝাল-ঝোলের মিশেলে এক পাতে দুই বাংলার ভোজ-সম্ভার পেশ করেছিলেন পৃথা। শিকড়কে জানতে মা-দিদিমার রান্নাকেই ইদানীং অনেক প্রবাসী আঁকড়ে ধরছেন।
মুম্বই-দিল্লিতে এক বেলার ভোজ-আসর বা পপ-আপ মিলের চল কলকাতার থেকে কিছুটা বেশি। তবে একেলে হেঁসেলে আধুনিক সরঞ্জামের দৌলতে নিউক্লিয়ার পরিবারেও সর্বত্র রান্নার চল বাড়ছে। পাড়ায়-পাড়ায় কেক তৈরির হোম-বেকার আর হোম-শেফদের বিপুল নামডাক। কলকাতাতেও হোম-শেফদের ঘরোয়া নাগা পর্ক মেনুর আহ্বানে হামলে পড়ছে বহু বাঙালিই। নাগাল্যান্ড হাউসের ক্যান্টিনের উৎকর্ষ আম কলকাত্তাইয়ারা এতদিন জানতেনও না। শহরের পর্কপ্রেমীদের উৎসাহে তার নামডাক ছড়িয়ে পড়েছে। কালিম্পঙে জন্ম, আদতে তিব্বতি মহিলা ডোমা ওয়াংয়ের রন্ধনশৈলীও এত দিন সিকিম হাউজ়ের ক্যান্টিন ব্লু পপির বাইরে কেউ জানতই না। ২০১৮-এ ডোমা ব্লু পপির পাশেই থাক্কালি আর পার্ক
সার্কাস পাড়ায় শিমশিম বলে দু’টি রেস্তরাঁ খুলেছেন। পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে চাখা মাংস বা শাক আনাজের দুরন্ত সব পদ এখন কলকাতাতেই মিলছে। থাক্কালির টেক্কা পর্কপদ আর শিমশিম বিফ বিশারদ। পর্ক স্যালাড ছোইলা বা বিফ মোমো-থুকপা বাটি-বাটি সাবড়ে ফেলছে বাঙালি। এর মাঝে ছন্দা দত্তের বর্মী রান্নার চিলতে রেস্তরাঁটি অবশ্য বন্ধ হয়েছে। কিন্তু ছন্দার দাবি, চাহিদার ভাটায় নয়, আর একটু বড় জায়গায় তাঁরা ফেরার তোড়জোড় করছেন।
সোশ্যাল মিডিয়ার দাপটের যুগে নতুন প্রাণ সঞ্চার হয়েছে টেরিটিবাজারের দু’টি সাবেক চিনে ইটিংহাউস ডি’লে ও তুং নামের। কলকাতার পর্কঅ্যাডিক্ট দলের আবদারে খুদে পারিবারিক রেস্তরাঁগুলি ১০০ লোকের ভোজ রেঁধেও তাক লাগিয়ে দিচ্ছে। খাবার সরবরাহের রকমারি অ্যাপের যুগে বহু রেস্তরাঁর পদই এখন সহজে হাজির। এখানেও আশঙ্কার কাঁটা! পাড়ার অনামা কিন্তু দুরন্ত ফুলকপির শিঙাড়া বা দুধপুলি-কাঁচাগোল্লা স্রষ্টা ‘রামকৃষ্ণ সুইটস’রা কি তবে বিস্মরণে তলিয়ে যাবে?
গ্লোবাল যুগে ছোট-ছোট লোকাল ঘরানার স্পর্ধার পটভূমিতেও বাঙালির মন বোঝা অবশ্য অত সোজা নয়। বাঙালি রান্না নিয়ে নিরীক্ষার রেস্তরাঁ বোহেমিয়ানের নতুন মেনু ছকে-বাঁধা বাঙালিয়ানাপন্থী নয়। এই পৌষে রাভিয়োলি পাস্তার পাটিসাপ্টাও শহর মাতাচ্ছে। মরাঠি সাওজি মশলার কিমা থেকে একান্তই মৌলিক টক-ঝাল কোকাকোলা চিকেনও বাঙালির পথ্যি হিসেবে পেশ করছেন বোহেমিয়ানের কাপ্তেন শেফ জয়মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
চেনা স্বাদের জমিতে দাঁড়িয়েও অজানা স্বাদের না-জানি কী-র টানে হাত বাড়াচ্ছে ২০১৯-এর বাঙালি।