বিশ বছর আগে পর্যন্ত প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হয়ে কলেজের হস্টেল পাওয়া যেত না স্রেফ মুসলমান হওয়ার কারণে। অনেক আন্দোলনের পরে সেই সাম্প্রদায়িক ব্যবস্থার বদল হয়েছে। কিন্তু আজও এই শহরে মুসলমান তরুণী বা মুসলমান দম্পতি বাড়ি ভাড়া পান না শুধু ধর্মের কারণে। হিন্দু ছাত্রের মেস আলাদা, ছাত্রীদের ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা। অথচ আমরা ডিজিটাল ভারতের দিকে ‘ফাইভ জি’ গতিতে এগোচ্ছি।
কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার পথে কোনও দিন রবীন্দ্রসদন-পিজি এলাকার বাসস্টপে বা হাওড়া স্টেশনের বিভিন্ন দেওয়ালে এখনও দেখতে পাওয়া যায়, ‘হিন্দু পেয়িং গেস্ট চাই’ লেখা পোস্টার। দীর্ঘ দিন ধরে লালন করে আসা এই বিভেদ-বুদ্ধির সপক্ষে বাড়িমালিকেরা যুক্তি দেন, ওঁদের খাওয়াদাওয়ার অভ্যেস আলাদা, ওঁরা গরু খান, নমাজ পড়েন, তাঁর বাড়িতে কুলদেবতা আছেন। কিন্তু এক জন মানুষ খাদ্যাভ্যাসের কারণে কেন বাড়ি পাবেন না? বহু হিন্দুও তো গোমাংস খান। তাঁদের ক্ষেত্রে কি একই অসুবিধা হয় বাড়িমালিকদের? জানা নেই। কিন্তু জানা আছে এমন সব কথা, যা শুনলে অবাক হওয়া শুধু নয়, লজ্জায় সঙ্কুচিত হতে হয়। যেমন, মুসলমান ঢুকলে রান্না করা খাবার ফেলে দিতে হয়। অতটা না করলেও পানীয় জলটুকু তো ফেলতেই হয়।
অবস্থা সর্বত্র যে একই রকম, তা নয়। অনেকে বেশ প্রগতিশীল। তাঁরা এ সবের ধার ধারেন না। কিন্তু পিসেমশাই বা খুড়শ্বশুরদের ‘চাপে’ অনেকে মুসলমান পেয়িং গেস্টকে থাকতে দিতে এখনও রাজি নন। ইদানীংকালে বহু মানুষ কলকাতায় পড়তে আসেন বা কাজ করতে। রাজাবাজার বা মেছুয়ায় তো স্থান সঙ্কুলান হয় না। কোথায় যাবেন ওই মানুষেরা? কলকাতা শহর বাড়ছে প্রতিদিন। তার সঙ্গেই যেন বাড়ছে ধর্মের নামে ভেদাভেদ। আগে যে সব সমস্যা দেখা যেত না, তেমন অনেক কিছুই দেখা দিচ্ছে আজকাল। সহনাগরিকদের একসঙ্গে থাকতে না দিয়ে, বাড়ি ভাড়া না দিয়ে বা ফ্ল্যাট কিনতে বাধা দিয়ে যেন এক ধরনের ‘অপারেশন’ চালানো হচ্ছে। এই ‘অপারেশন’ রোজ চলছে গোটা পৃথিবীতে। তাতেই কেন যেন পা মিলিয়ে ফেলছে আমাদের শহরও। দুনিয়া জুড়ে ইসলামের নামে সন্ত্রাস এর একমাত্র কারণ নয়। আমাদের শহরে বাড়তে থাকা এই মনোভাবের পিছনে রয়েছে অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি ঘৃণাও। তাই আজও এ শহরে বহু মুসলমানকে হিন্দু আত্মীয়দের পরিচয় দিতে হয় বাড়ি কিনতে গেলে। আমারও এমন অভিজ্ঞতা কম হয়নি।
সংখ্যাগুরুরাও বিপন্ন। তাঁদের বিপদে ফেলছে নিজেদের মানসিক ভূগোল। রয়েছে ভয়, ঘৃণা, কুসংস্কার। মুসলমানমাত্র সন্ত্রাসবাদী— অথচ এক বারও ওই সব মানুষেরা ভেবে দেখেন না যে, সারা দুনিয়ার নিরানব্বই শতাংশের বেশি মুসলমান সন্ত্রাসের ধারকাছ দিয়েও যান না, তাঁরাও আর পাঁচটা সাধারণ লোকের মতোই খান-দান-ঘুমোন। ভেবে দেখার অভ্যাসটাই কি আসলে হারিয়ে ফেলছে এই শহরটা? এ দেশে সেই অর্থে কোনও দিন হিন্দু-মুসলমানের ভীষণ সৌহার্দ ছিল না। কিন্তু এ শহরে এমন ঘৃণাও ছিল না, যা ইদানীং দেখতে পাওয়া যায়। মুসলমান-ফোবিয়া কৃত্রিম উপায়ে বাড়ানো হয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থে, ভোটের জন্য। শহরের মানুষও যেন সেই ফাঁদেই বারবার পা দিচ্ছেন।
কলকাতায় মুসলমানদের বাড়ি ভাড়া না দেওয়া আসলে ‘অতলান্তিক ঘৃণা’ নামক সেই হিমশৈলের চূড়ামাত্র। আমাদেরই অজান্তে এ শহরে রোজ এই বিদ্বেষ বাড়ছে। ভারতীয় রাজনীতির দিক পরিবর্তন হলেও সেই ক্ষত সারতে ঠিক যে কত দিন লাগবে, তা কেউ জানে না।
তবে আশার কথা, মুসলমানদের বাড়ি ভাড়া না দেওয়ার বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরু বহু মানুষ এগিয়ে এসেছেন। তাঁরা আইনের সাহায্য নিচ্ছেন, শহরে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। তাতে উল্টো দিকের মানুষেরা যে বুঝছেন না, এমন নয়। এই ধরনের উদ্যোগ যত বেশি হবে, তত মঙ্গল সমাজের। সর্বস্তরে এই সচেতনা ছড়িয়ে দিতে পারলে ভাল। প্রশাসন যেন এমন মানুষদের সাহায্য করেন, যাতে ‘বঞ্চিত’ মানুষ সাহায্যের হাতটুকু পান। কলকাতা অন্য রকম— এখনও এই ভরসা ও ভালবাসা নিয়েই বেঁচে থাকা।