লজ্জায় আমার ডাক্তারি ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে

সব চেয়ে দুঃখের বিষয়, এই ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজেই পাঁচ বছর পড়েছি আমি। ইন্টার্নশিপ চলার সময়ে অনেক বার এ রকম ইমার্জেন্সি কেস সামলেছি। কখনও বলিনি, ‘‘আমাদের পরিকাঠামো নেই’’ অথবা ‘‘আমরা পারব না’’।

Advertisement

সুজিত বিশ্বাস

(মৃত ছাত্রের বাবা) শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০২:৩৬
Share:

বাবা-মায়ের সঙ্গে সায়ন্তন। পারিবারিক অ্যালবাম থেকে।

রবিবার সকাল সকাল তেহট্ট যাচ্ছিলাম, আমাদের দেশের বাড়ি। আটটা চল্লিশ নাগাদ ফোন পেয়েই গাড়ি ঘোরালাম। ছোট ছেলে সায়ন্তনের দুর্ঘটনা ঘটেছে। তার কুড়ি মিনিটের মাথায় আরও একটা ফোন এল। অবস্থা খুব আশঙ্কাজনক। তখন সত্যিটা আমায় বলা না-হলেও, আমি বুঝতেই পেরে গিয়েছিলাম, ছেলে আর নেই। বাড়ি গিয়ে, টাকাপয়সা নিয়ে, স্ত্রীকে আর বড় ছেলে সৌম্যজিৎকে সঙ্গে করে যখন বাইপাসের মেডিকায় পৌঁছলাম, তখন দুপুর হয়ে গিয়েছে। গিয়ে শুনলাম, সত্যিই সব শেষ।

Advertisement

প্রথমেই ছেলের সহপাঠী শুভদীপের মুখোমুখি হই আমি। জানতে চাই, ঠিক কী হয়েছিল। ও অনেকটাই সুস্থ তখন। শুভদীপ আমায় বলে, দুর্ঘটনার পরে ওরা সঙ্গে সঙ্গে সকালবেলায় ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে পৌঁছলেও, বেশ কিছু ক্ষণ ধরে মেঝেতেই পড়েছিল। প্রাথমিক চিকিৎসাটুকুর পরে আর কিছুই করা হচ্ছিল না ওদের। তখনও বেঁচে আমার ছেলেটা। কেন আর কিছু করা হচ্ছে না জিজ্ঞেস করলে এক চিকিৎসক নাকি শুভদীপকে বলেন, ‘‘এখানে এর চেয়ে ভাল ব্যবস্থা নেই। চাইলে অন্য কোথাও চলে যেতে পারো।’’

আমি নিজেও পেশায় ডাক্তার। হাসপাতালের এক জন চিকিৎসকের এমন আচরণ আমার অচেনা, অজানা। আর সরকারি হাসপাতালে ‘পরিকাঠামো নেই’ মানে কী! রাজ্যের সেরা পরিকাঠামো তো এখানেই থাকার কথা! স্বাভাবিক ভাবেই চিকিৎসকের মুখে ওই কথা শুনে ঘাবড়ে যায় শুভদীপ, প্রশ্ন করে কোথায় যাবে ওরা। ওদের বলা হয়, বাইপাসেই তো বেশ কিছু ভাল বেসরকারি হাসপাতাল আছে। এর পরেই মেডিকা যায় ওরা। আর সেই যাওয়ার পথেই...

Advertisement

সব চেয়ে দুঃখের বিষয়, এই ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজেই পাঁচ বছর পড়েছি আমি। ইন্টার্নশিপ চলার সময়ে অনেক বার এ রকম ইমার্জেন্সি কেস সামলেছি। কখনও বলিনি, ‘‘আমাদের পরিকাঠামো নেই’’ অথবা ‘‘আমরা পারব না’’। সব সময় সর্বোত্তম চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি, আর সেই আশ্বাসই দিয়েছি রোগী ও রোগী পরিজনেদের। ওদের যে ধরনের কথা বলা হয়েছে, তা তো অন্য জায়গায় নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য এক রকম জবরদস্তি করা!

আরও পড়ুন: প্রায় জোর করেই তো পাঠিয়ে দেওয়া হল আমাদের

হাসপাতাল বলছে, শুভদীপের কথায় এবং ওর সই করা রিস্ক বন্ডের ভিত্তিতে অন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে ছেলেকে। কিন্তু পরিকাঠামো না-থাকার কথা শুনে শুভদীপের আর কী-ই বা করার ছিল? এটা তো হাসপাতালের দায় এড়ানো মানসিকতার পরিচয়। হাসপাতাল চিকিৎসাও করল না, আবার ‘রেফার’ করার দায়িত্বও নিজের ঘাড়ে রাখল না। এমনকী একটা ভাল অ্যাম্বুল্যান্স পর্যন্ত দেয়নি হাসপাতাল। রাস্তা থেকে সাধারণ অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করে শুভদীপরা। তাতে লাইফ সাপোর্ট ছিল না। ওটুকু থাকলেও হয়তো ছেলেটা...

আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না, যে মেডিক্যাল কলেজ থেকে আমি পাশ করলাম, সেখানেই আমার ছেলের সঙ্গে এমনটা হল! আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না। কিন্তু ঘটনা পরম্পরা শোনার পরে তো স্পষ্ট বুঝতে পারছি, ওর সঙ্গে অন্যায় হয়েছে। গাফিলতিতেই মারা গেল ও। এর তদন্ত হোক, বিচার হোক।

এই লজ্জায়, এই যন্ত্রণায় আমার ডাক্তারি ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন