জোরে হর্ন দিচ্ছিলাম, যদি কেউ শুনতে পায়

উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। গাড়ির চার পাশে শুধু বরফ আর বরফ। আমরা চাপা পড়ে গিয়েছি। গাড়ির সামনের সিটে আমার পাশেই বসে ছিল সাহেবের ছেলে (সৌম্যদীপ)। সাহেব (পদ্মনাভ বসু) আর ম্যাডাম (রাজশ্রীদেবী) ছিলেন পিছনের সিটে। মোবাইল থেকে আমার বন্ধুদের ফোন করার চেষ্টা করছি বারবার। যাতে পুলিশের কাছে খবরটা পৌঁছে দেওয়া যায়। কিন্তু কিছুতেই লাইন পাওয়া গেল না।

Advertisement

আবদুল হক (পদ্মনাভ বসুর গাড়ির চালক)

লেহ্ শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৫ ০৩:৫৩
Share:

উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। গাড়ির চার পাশে শুধু বরফ আর বরফ। আমরা চাপা পড়ে গিয়েছি। গাড়ির সামনের সিটে আমার পাশেই বসে ছিল সাহেবের ছেলে (সৌম্যদীপ)। সাহেব (পদ্মনাভ বসু) আর ম্যাডাম (রাজশ্রীদেবী) ছিলেন পিছনের সিটে।
মোবাইল থেকে আমার বন্ধুদের ফোন করার চেষ্টা করছি বারবার। যাতে পুলিশের কাছে খবরটা পৌঁছে দেওয়া যায়। কিন্তু কিছুতেই লাইন পাওয়া গেল না। সাহেব আর তাঁর ছেলেও বহু বার মোবাইল থেকে ফোন করার চেষ্টা করলেন। হল না।
এ বার ভয় পেলাম। কী করব, মাথায় আসছিল না। চার জনেই ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করতে লাগলাম। কিন্তু কাছাকাছি তখন কোনও গাড়ি ছিল না। খারদুং লা পাস পেরিয়ে তিন-চার কিলোমিটার এসেছি। ওই সময় ওখান দিয়ে অনেক গাড়িই যাতায়াত করার কথা। তাই কিছু ক্ষণ পর-পর চিৎকার করছিলাম, যদি কেউ শুনতে পায়! যে ভাবে বরফে ঢেকে গিয়েছি আমরা, তাতে গাড়ির দরজা খোলা সম্ভবই হয়নি। গাড়ির ভিতরের আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিলাম। সাহেবরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। তাঁদের ভাষা বুঝিনি।

Advertisement

খারদুং লা পাস পৌঁছনোর আগেই পুলিশের আউটপোস্ট। প্রতিটি গাড়ির নম্বর, চালকের পরিচয় নথিভুক্ত করা হয় সেখানে। নুব্রাতে সেই সব গাড়ি পৌঁছল কি না, তারও খোঁজ নেওয়া হয়। তাই একটাই ভরসা করছিলাম মনে মনে, কেউ না কেউ আমাদের খোঁজ নিশ্চয় নেবে!

সাড়ে ১৭ হাজার ফুট উঁচুতে এই পথ। সওয়ারিদের শ্বাসকষ্ট হতে পারে ভেবে গাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার তুলে রেখেছিলাম। ৩১ মে থেকে ৭ জুন পর্যন্ত সেটা কাজে লাগেনি। কিন্তু ৮ তারিখ বরফ চাপা পড়ার কিছু ক্ষণ পর থেকেই বুঝলাম গাড়ির ভিতরে বাতাস নেই, অক্সিজেন দরকার। পালা করে অক্সিজেন নিতে শুরু করি। জলও খাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে জোরে জোরে হর্ন বাজাচ্ছি। সে আওয়াজ আদৌ বাইরে পৌঁছচ্ছে কি না, জানি না। গাড়ি স্টার্ট করাও সম্ভব ছিল না। চার দিকে এমনই বরফের দেওয়াল হয়ে গিয়েছে যে, স্টার্ট দিলে কালো ধোঁওয়া বাইরে না বেরিয়ে গাড়িতেই ঢুকবে। তাতে আরও দমবন্ধ অবস্থা হবে।

Advertisement

এই এলাকায় বহু বার পর্যটকদের নিয়ে যাতায়াত করেছি। প্রতি বছর শীতের পর মে মাসের শেষে রাস্তা খোলে, পর্যটক আনাগোনা শুরু হয়। কিন্তু এমন তো আগে কখনও ঘটেনি! সোমবার সকালেও যখন রওনা হই, তখন আকাশ একেবারে পরিষ্কার। সকাল ৮টায় লেহ্ থেকে রওনা হয়ে মাঝে এক বার থেমেছিলাম। গাড়ি থেকে নেমে ওঁরা ছবি তুললেন। খারদুং লা পাসেও ফের এক প্রস্ত ছবি তোলা হল। শেষ মুহূর্তেও বুঝতে পারিনি, কী ঘটতে চলেছে!

সাহেবের মন শক্ত। কিন্তু ম্যাডাম আর লড়কা খুবই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। সাহেবের ছেলে মাঝেমধ্যেই পিছনে মায়ের কাছে যাচ্ছিল। আবার সামনে এসে বসছিল। আমি বললাম, ‘‘ছটফট কোরো না! অক্সিজেন বেশি নেই। কেউ না কেউ আমাদের উদ্ধার করবে।’’

ন’দিন একসঙ্গে ছিলাম। ওঁদের সঙ্গে বেশ ভাল সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। মঙ্গলবার সকালে হাসপাতাল থেকে আমাকে ছাড়ল। তখনও জানি না, সাহেবের ছেলে আর ম্যাডাম যে নেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন