Road Accident

একমুখী পথে ঢুকে পড়াতেই দুর্ঘটনা বেশি, হুঁশ ফিরবে কবে?

উল্টো দিক থেকে আসা গাড়ির ধাক্কায় দুমড়ে যায় তাঁর গাড়িটি।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০২১ ০৩:২৯
Share:

অমান্য: নিয়ম না মেনেই ইউ-টার্ন করছে গাড়ি। এ জে সি বসু রোড-রিপন স্ট্রিটের সংযোগস্থলে। ক্যানাল ওয়েস্ট রোডে নো-এন্ট্রি বোর্ড না মেনে একমুখী রাস্তায় ঢুকে পড়ছে গাড়ি এবং স্কুটার। ছবি: রণজিৎ নন্দী

ঘটনা ১: দিন কয়েকের মধ্যেই বিয়ে হওয়ার কথা ছিল জোড়াসাঁকোর সুশোভন সরকারের। বাড়ি ভাড়া নেওয়া, বিয়ের কেনাকাটা, আত্মীয়দের নিমন্ত্রণ— সবই সারা হয়ে গিয়েছিল। হবু স্ত্রীকে উপহার হিসেবে স্বাস্থ্য বিমা করিয়ে দেবেন বলে বিমা সংস্থার সঙ্গে কথাবার্তাও পাকা করে রেখেছিলেন সুশোভন। কিন্তু বিয়ে আর হয়নি। তার দিন কয়েক আগেই ক্যানাল ইস্ট রোড ধরে মোটরবাইকে যাওয়ার সময়ে উল্টো দিক থেকে নিয়ম ভেঙে ঢুকে পড়া গাড়ির ধাক্কায় সুশোভন এখন শয্যাশায়ী। বৃদ্ধা মা আর দাদার পরিবারের ভরসায় দিন কাটছে। পাত্রীকে বিয়ে করতে হয়েছে অন্যত্র।

Advertisement

ঘটনা ২: রাতে সময় বাঁচাতে আমহার্স্ট স্ট্রিটের একমুখী রাস্তায় গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন খাবারের বিপণিতে বরাত পৌঁছে দেওয়ার কাজ করা ই এম বাইপাসের দত্তাবাদের বাসিন্দা সুখেন দাস। উল্টো দিক থেকে আসা গাড়ির ধাক্কায় দুমড়ে যায় তাঁর গাড়িটি। পুলিশ পৌঁছনোর আগেই মৃত্যু হয়েছিল সুখেনের। বাড়িতে বৃদ্ধা মা আর বোন। ছেলের মৃত্যুর পর থেকেই বৃদ্ধাকে এখন প্রায় প্রতি সপ্তাহে আদালতে ছুটে বেড়াতে হচ্ছে দুর্ঘটনায় মৃত ছেলের জীবন বিমার টাকা পেতে। কিন্তু নিজেই ট্র্যাফিক নিয়ম ভেঙে ভুল পথে ঢুকে দুর্ঘটনা ঘটানোয় সুখেনের পরিবার টাকা পাবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন।

এমনই একাধিক প্রশ্ন এবং দুর্ঘটনার উদাহরণ জিইয়েই বর্তমান রয়েছে গাড়ি বা মোটরবাইক নিয়ে ভুল পথে ঢুকে পড়ে বিপদ ঘটানোর পুরনো রোগ। শহরের বহু জায়গাতেই রাস্তা একমুখী না দ্বিমুখী সে সম্পর্কে ধারণাই থাকে না চালকদের। ট্র্যাফিক সিগন্যালের পরোয়া তো নেই-ই, উল্টে অনেকেই মানেন না পুলিশের লাগানো পথ-নির্দেশিকার বোর্ডও। কিছু ক্ষেত্রে গাড়ি বা বাইকের থেকেও বেপরোয়া অটো বা ট্যাক্সির চালকেরা।

Advertisement

আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে জাতীয় ক্রাইম রেকর্ডস বুরো জানিয়েছে, ২০১৮ সালে দেশে নিয়ম ভেঙে ভুল পথে গাড়ি চালানোয় প্রতিদিন ২৪ জন করে মারা গিয়েছেন। ২০১৯ সালে সেখানে এই ধরনের দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ৯,৬০০ জন। অর্থাৎ, প্রতি ঘণ্টায় এক জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে ভুল পথে গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়া সংক্রান্ত দুর্ঘটনায়। ২০২০ সালের এই সংক্রান্ত রিপোর্ট এখনও প্রকাশিত হয়নি। যদিও কলকাতা পুলিশ সূত্রের খবর, গত এক বছরের বেশ কিছুটা সময় লকডাউন চললেও শহরে ভুল পথে গাড়ি চালানোর জেরে মামলা হয়েছে প্রায় ৪,৯০০টি। মৃত্যু হয়েছে ৬৭ জনের। যদিও এই সংখ্যাটি বছরের চূড়ান্ত রিপোর্টে আরও বাড়তে পারে বলেই পুলিশ সূত্রের খবর।

কিন্তু ভুল পথে গাড়ি চালানোর এই রোগে লাগাম টানা যায় না কেন?

জন-সচেতনতার অভাবের পাশাপাশি পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। উত্তর কলকাতার ক্যানাল ইস্ট রোডে এমনই অভিযোগ রয়েছে। ওই রাস্তা দিয়ে আর জি কর হাসপাতালের দিকে, উত্তরে যাওয়ার জন্য বরাদ্দ করেছে পুলিশ। উল্টো দিকে যাওয়ার জন্য রাখা হয়েছে ক্যানাল ওয়েস্ট রোড। কিন্তু দিনভরই সেখানে ট্র্যাফিক বিধি লঙ্ঘনের একাধিক ছবি। একমুখী পথের নিয়ম মানেন না কেউই। অভিযোগ, রাতে ট্র্যাফিক পুলিশ না থাকার সুযোগে এই প্রবণতা আরও মাত্রাছাড়া আকার নেয়। ওই রাস্তার বহু জায়গায় নেই কোনও সিসি ক্যামেরার নজরদারিও। অথচ, এই রাস্তাতেই রয়েছে মানিকতলা এবং নারকেলডাঙা থানা। একই অবস্থা উল্টোডাঙা মেন রোড, বেলগাছিয়া রোড, কাশীপুর সংলগ্ন একাধিক রাস্তাতেও। এ জে সি বসু রোড, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড, কালীঘাট রোড এবং কসবা কানেক্টর ঘিরেও একমুখী রাস্তার ব্যবহার নিয়ে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। এন আর এস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে এই একমুখী রাস্তাতেই গত দু’মাসে একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশ সূত্রের খবর। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড ধরে ময়দান থানার দিকে যাওয়ার পথে আবার মাথার উপরের সেতুর প্রতিটি স্তম্ভে লাগানো ‘নো ইউ-টার্ন বোর্ড’। কিন্তু সে নিয়ম মানেন না কেউই। পুলিশের সামনে দিয়েই চলে যথেচ্ছ ঘোরাঘুরি।

যদিও কলকাতা পুলিশের দাবি, মোটরযান আইনের ১১৫ নম্বর ধারায় নিষিদ্ধ রাস্তায় ঢুকে পড়া সংক্রান্ত মামলা দিয়ে এই ধরনের গাড়িগুলির বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ধরপাকড়ও চলছে।

একমুখী রাস্তায় ঢুকে পড়া সংক্রান্ত দুর্ঘটনার সংখ্যা কমেছে দাবি করে ডিসি (ট্র্যাফিক) রূপেশ কুমার বলেন, ‘‘চালকদেরও সচেতন হতে হবে। এ নিয়ে সচেতনতার কাজ যে ভাবে এত দিন চলছিল, সে ভাবেই চালানো হবে।’’

কিন্তু সেই সচেতনতায় কাজ হচ্ছে কই? উত্তরহীন সব পক্ষই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন