দৃশ্য-১। সন্ধ্যার ব্যস্ত সময়। পার্ক স্ট্রিটের ফুটপাথে ঠাসাঠাসি ভিড়ে এক হাত অন্তর অন্তর স্মার্টফোন বা ট্যাব হাতে দাঁড়িয়ে তরুণ-তরুণী। কোথাও কিশোরদের জটলা। পথচলতি মানুষেরা তাড়াহুড়োয় ধাক্কা দিয়ে গেলেও তাঁরা কিন্তু ‘কুছ পরোয়া নহি’ মনোভাবে অটল!
দৃশ্য-২। রাত সাড়ে ১০টা। রাসবিহারী অ্যাভিনিউ ও প্রতাপাদিত্য রোডের মোড়। ট্যাব হাতে আনমনে রাস্তায় নেমে এল এক কিশোর। পিছন থেকে গাড়ির হর্নেও হুঁশ ফিরছে না তার!
রাস্তায় ‘ফ্রি’ ওয়াই-ফাইয়ের সৌজন্যে এটাই এখন মহানগরের চেহারা! নিত্যযাত্রীরা বলছেন, এই ‘নেটচারী’-দের দাপটে যে কোনও সময়েই ঘটতে পারে দুর্ঘটনা! অনেকেই এর সঙ্গে বিদেশে ‘পোকেমন গো’ গেম নিয়ে উন্মাদনারও মিল খুঁজে পাচ্ছেন। পথে পোকেমন পাকড়াও করতে গিয়ে সেখানেও দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছেন অনেকেই।
ওয়াই-ফাইয়ের নেশায় দুর্ঘটনার আশঙ্কা যে মিথ্যে নয়, তা অবশ্য প্রমাণ হয়েছে ১৭ অগস্ট রাতেই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন নম্বর গেটের সামনে উপড়ে পড়া গাছের তলার চাপা পড়েন অভিজিৎ ভৌমিক নামে এক যুবক। পুলিশের দাবি, ‘ফ্রি’ ওয়াই-ফাই দিয়ে সিনেমা ডাউনলোড করতেই সেখানে হাজির হয়েছিলেন অভিজিৎ। পুলিশ জেনেছে, সে দিন ওই গাছের তলায় চাপা পড়া আরও কয়েক জনও নিখরচার ওয়াই-ফাই ব্যবহার করতে গিয়েছিলেন।
শহরে নানা জায়গায় বিনামূল্যে এই পরিষেবা দিচ্ছে রাজ্য সরকার। একই জিনিস মিলছে মেট্রো স্টেশনেও। আর নিখরচায় সেই সুযোগ নিতে হামলে পড়ছেন লোকজন। চাঁদনি চকের এক অফিসকর্মী বলছেন, মাসে ২ জিবি ইন্টারনেটে গেম ডাউনলোড বা ইউটিউবে গান শোনা সম্ভব নয়! তাই যাতায়াতের পথে মেট্রো স্টেশনে ওয়াই-ফাই ব্যবহার করেন। ছুটির দিনে সিনেমা ডাউনলো়ড করতে ছেলেকে নিয়ে কৈখালি থেকে শ্যামবাজার পাড়ি দেন, এমন লোকও রয়েছেন! রাতে উত্তর কলকাতা থেকে গড়িয়াহাটে ফেরার পথে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে অল্পবয়সীদের জটলা দেখে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন এক প্রৌঢ়। পরে জেনেছিলেন, ওটাও শহরের ‘ফ্রি ওয়াই-ফাই জোন’।
মেট্রো স্টেশন, শপিং মলের ফ্রি ওয়াই-ফাইয়ে সমস্যা নেই। কিন্তু ঝঞ্ঝাট বাড়ছে পথেঘাটে নেট-সন্ধানীদের নিয়ে— বলছেন পুলিশের অনেকেই। এক ট্রাফিক সার্জেন্টের কথায়, ‘‘ফ্রি পরিষেবা নেওয়া অন্যায় নয়। কিন্তু ফুটপাথ থেকে আচমকা রাস্তায় নেমে এলে সামলানো যায় নাকি!’’ কেউ কেউ আবার এর সঙ্গে কানে হেডফোন গুঁজে রাস্তা, ট্রেন লাইন পেরোনোর মিল পাচ্ছেন। তাঁরা বলছেন, হেডফোন কানে গুঁজে ট্রেন লাইন পেরোতে গিয়ে দুর্ঘটনা তো কম হল না! হাজারো সচেতনতা প্রসার, ধরপাকড় করে লাভ হয়েছে কি?
তা হলে উপায়? পুলিশ বলছে, ট্যাব বা স্মার্টফোন হাতে রাস্তায় নেমে আসতে দেখলে আটকানো হয়। কখনও কখনও বকাঝকাও চলে। কিন্তু এটা পাকাপাকি সুরাহা নয়। তাই লালবাজারের অফিসারদের উপদেশ, ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ওয়াই-ফাই করুন। কিন্তু রাস্তায় নেমে নিজের বিপদ বাড়াবেন না। পথেঘাটে যাতে অন্যদের অসুবিধা না হয়, সেটাও খেয়াল রাখা উচিত। সাইবার বিশেষজ্ঞদের একাংশ সাবধান করছেন, ওয়াই-ফাই ব্যবহার করে অনলাইন ব্যাঙ্কিং বা কেনাকাটা না করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। বহু ক্ষেত্রেই ‘ফ্রি’ ওয়াই-ফাই মারফত হ্যাকিং বা ফোনে-ট্যাবে ভাইরাস ঢুকিয়ে দিতে পারে দুষ্কৃতীরা। সাইবার বিশেষজ্ঞ বিভাস চট্টোপাধ্যায় যেমন বলেন, ‘‘কোনও ইন্টারনেট সংযোগই পুরোপুরি নিরাপদ নয়। তবে এ ধরনের ওয়াই-ফাইয়ে বিপদের ঝুঁকি বেশি।’’