বম্বে গ্রুপের রক্ত পেতেই ৩০ ঘণ্টা পার

ঘটনা জানাজানি হতে স্বাস্থ্য ভবনও স্বীকার করেছে কেন্দ্রীয় ভাবে বম্বে গ্রুপের রক্তদাতাদের সম্বন্ধে তথ্য দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা এখনও তৈরি করা যায়নি। 

Advertisement

সৌরভ দত্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৯ ০০:১৯
Share:

প্রতীকী ছবি।

অতীতে একাধিক বার ঘটেছে এমন সমস্যা। কিন্তু তা থেকেও রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর শিক্ষা নেয়নি। আবারও সঙ্কটের মুহূর্তে বম্বে গ্রুপের রক্ত জোগাড় করতে নাজেহাল হতে হল রোগীর পরিবারকে। এ বার হেনস্থার শিকার হল এক সদ্যোজাত শিশুর পরিবার। সকালে চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন সন্ধ্যায় শিশুটির অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন। তার পরে শিশুটির রক্তের নমুনা পরীক্ষা করে সামনে আসে বিরল বম্বে গ্রুপের বিষয়টি। প্রায় তিরিশ ঘণ্টা পরে রোগীর পরিবারকে নিজেদের চেষ্টায় বম্বে গ্রুপের রক্তদাতাকে খুঁজে বার করতে হল। ঘটনা জানাজানি হতে স্বাস্থ্য ভবনও স্বীকার করেছে কেন্দ্রীয় ভাবে বম্বে গ্রুপের রক্তদাতাদের সম্বন্ধে তথ্য দেওয়ার কোনও ব্যবস্থা এখনও তৈরি করা যায়নি।

Advertisement

পেটে সংক্রমণ নিয়ে লেক টাউনের দক্ষিণদাঁড়ির বাসিন্দা পাঁচ দিন বয়সের এক শিশুকে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়েছিল গত বুধবার। মহম্মদ সুভান নামে ওই শিশুর পেট অস্বাভাবিক রকমের ফুলে গিয়েছিল। শনিবার সন্ধ্যায় শিশুটির অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তার আগে পরিবারটি জানতে পারে শিশুটির বম্বে গ্রুপের রক্তের প্রয়োজন। কিন্তু অস্ত্রোপচারের আগে সেই ‘বিরল’ রক্ত জোগাড় করতে পারেনি পরিবারটি। শিশুটির বাবা মহম্মদ সফিকুল বলেন, ‘‘অস্ত্রোপচার শেষে চিকিৎসকেরা জানান জ্ঞান ফিরলেও বাচ্চার অবস্থা ভাল নয়। রক্ত দিতেই হবে।’’ কালবৈশাখীর রাতে এর পরে ঝড়-জল মাথায় করে ছোট্ট সুভানের জন্য বম্বে গ্রুপের রক্ত খুঁজতে শহরের সরকারি-বেসরকারি— বিভিন্ন ব্লাডব্যাঙ্কে ছোটে পরিবারটি।

সফিকুলের অভিযোগ, ‘‘মানিকতলা, মেডিক্যাল, আরজিকর— সারা রাত ধরে সর্বত্র ঘুরেছি মাত্র এক ইউনিট রক্তের জন্য। কিন্তু বম্বে গ্রুপের রক্ত পাইনি।’’ এমনকি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে বার্তা দিয়েও লাভ হয়নি। শেষে দীপঙ্কর মিত্র নামে রক্তদান আন্দোলনের এক কর্মীর থেকে মৃদুল দলুই নামে বম্বে গ্রুপের এক রক্তদাতার সন্ধান পান সফিকুলেরা। শনিবার সকালের পর থেকে রক্ত নিয়ে তৈরি হওয়া সঙ্কট কাটে রবিবার সন্ধ্যায় মৃদুলবাবু পাঁচ দিনের ওই শিশুকে বম্বে গ্রুপের রক্ত দেওয়ার পরে। মঙ্গলবার সুভানের মা নার্গিস বিবি বলেন, ‘‘চিকিৎসকেরা বলেছেন এ বার ছেলে সুস্থ হয়ে যাবে।’’

Advertisement

বম্বে ব্লাড গ্রুপ কী

১৯৫২ সালে তৎকালীন বম্বে শহরে এক ব্যক্তির শরীরে প্রথম এই গ্রুপের রক্তের সন্ধান মেলে। তাই নাম বম্বে ব্লাড গ্রুপ। রক্তের অন্য গ্রুপগুলিতে কোনও না কোনও অ্যান্টিজেন থাকে। কিন্তু বম্বে ব্লাড গ্রুপের রক্ত, যা ওএইচ (Oh) বা এইচএইচ (hh) গ্রুপ নামেও পরিচিত, তাতে কোনও অ্যান্টিজেন নেই। সবটাই অ্যান্টিবডি। বিরল ‘বম্বে ব্লাড গ্রুপ’-এর রোগী শুধুমাত্র ওই গ্রুপেরই দাতার থেকে রক্ত গ্রহণ করতে পারেন। বিশেষ পরিস্থিতিতে O পজিটিভ গ্রুপকে সর্বজনীন দাতা ধরে নির্দিষ্ট পদ্ধতি মেনে সেই রক্ত অন্যদের দেওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু বম্বে গ্রুপের ক্ষেত্রে তা একেবারেই সম্ভব নয়।

নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে রক্তদাতা চুয়াল্লিশ বছর বয়সী মৃদুলবাবু বলেন, ‘‘১৮ বছর বয়স থেকে রক্ত দেওয়া সত্ত্বেও মাত্র দু’বছর আগে মানিকতলা ব্লাড ব্যাঙ্কে প্রথম জানতে পারি যে আমার রক্ত বম্বে গ্রুপের। এত দিন এত শিবিরে রক্ত দিলেও আমার রক্তের আসল গ্রুপ ধরা পড়েনি! আমি জানতাম, আমার রক্তের গ্রুপ ‘ও পজিটিভ’।’’

সর্বভারতীয় স্তরে বম্বে গ্রুপের রক্তদাতাদের নিয়ে তৈরি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দাবি, সারা দেশে এই গ্রুপের দাতার সংখ্যা সাড়ে পাঁচশো থেকে সাড়ে সাতশো। সংগঠনের কর্ণধার সচিন সিংলা জানান, তাঁদের কাছে কিন্তু এই সংক্রান্ত তথ্যভাণ্ডার রয়েছে। তাঁর দাবি, মঙ্গলবারই বার্নপুরে এক বৃদ্ধার জন্য তাঁরা জামশেদপুর অথবা কেরল থেকে বম্বে গ্রুপের দাতার ব্যবস্থা করছেন।

উল্লেখ্য, রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর কয়েক বছর আগে কেন্দ্রীয় ভাবে বম্বে গ্রুপের দাতা সংক্রান্ত তথ্য ভাণ্ডার তৈরি পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু আজও তা হয়নি। স্বাস্থ্যভবনের এক কর্তার কথায়, ‘‘মেডিক্যাল কলেজে চার জন, সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কে তিন জন এবং আর জি করে এক জন

বম্বে গ্রুপের রক্তদাতার নাম রয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ভাবে তাঁদের কোনও তথ্য নেই। এমন হয়রানি রোধে সব ধরনের রক্তদাতারই তথ্য ব্যাঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে।’’

কেন্দ্রীয় ভাবে তথ্য না থাকায় সমস্যার কথা স্বীকার করছে ব্লাডব্যাঙ্কগুলি। অভিযোগ রয়েছে তৎপরতার অভাবেরও। মৃদুল দলুইয়ের নাম মানিকতলার সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কের কাছেই ছিল। কিন্তু শনিবার রাতে দরকারের সময়ে তা পায়নি ওই পরিবারটি। অধিকর্তা স্বপন সোরেন বলেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে একটু সময় লাগে। পরের দিন ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারি মৃদুলবাবু শিশুটিকে রক্ত দিয়েছেন।’’

এনআরএসে অধিকর্তা দিলীপ পান্ডা বলেন, ‘‘আমাদের কাছে যাঁর নাম রয়েছে, তিনি সম্প্রতি রক্ত দিয়েছেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন