—প্রতীকী চিত্র।
দক্ষিণ কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে হার্টের সমস্যায় আক্রান্ত রোগী জানতে চাইলেন, কোন হৃদ্রোগ চিকিৎসক দায়িত্বে রয়েছেন। ওই চিকিৎসক মহিলা জানার পরেই তিনি অন্য হাসপাতালে রওনা হন।
আন্তর্জাতিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক সমীক্ষা জানাচ্ছে, অধিকাংশ মহিলা চিকিৎসক কর্মক্ষেত্রে রোগীর কাছে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হন। সম্প্রতি আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (এএমএ) তরফে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে এই তথ্য সামনে এসেছে। অনেকেই ভাবছেন, মার্কিন মুলুকের পরিস্থিতি এমন হলে, এ দেশের মহিলা চিকিৎসকদের অবস্থান আরও উদ্বেগজনক হতে পারে।
শহরের একটি হাসপাতালে এক মহিলা চিকিৎসকের অভি়জ্ঞতা, এক বার তিনি রোগীর পাশে দাঁড়িয়ে তাঁরই পরীক্ষার রিপোর্ট দেখছিলেন। কিন্তু রোগী নিজের উপসর্গের কথা জানাচ্ছিলেন সেখানে উপস্থিত হাসপাতালের এক পুরুষ কর্মীকে।
তবে এ ছবি অবশ্য বদলে যায় শিশু বিভাগ ও স্ত্রী-রোগ বিভাগে। সেখানে কিন্তু চিকিৎসক হিসেবে মহিলাদের চাহিদাই বেশি বলে জানাচ্ছে চিকিৎসা মহল।
কার্ডিওথোরাসিক চিকিৎসক কুণাল সরকার জানান, একাধিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, এমবিবিএস কোর্সে ভর্তির সময় ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৫৪ শতাংশ। কিন্তু স্নাতক স্তরে পাশ করে কাজে যোগ দেওয়া মহিলা চিকিৎসক মাত্র ৩০ শতাংশ। বহু ছাত্রী পড়াশোনা চলাকালীন হারিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘পড়াশোনার পর্ব থেকেই মহিলারা বাধার মুখে পড়েন। দীর্ঘ দিনের পেশাতেও সেটা দেখেছি। মহিলা চিকিৎসকদের দক্ষতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন। এটা ঠিক নয়। বিদেশে যখন উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়েছিলাম, এক মহিলা চিকিৎসকের কাছেই প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। তবে দেখেছিলাম সে দেশেও সমস্যা রয়েছে। আসলে, তাঁদের দক্ষতার তুলনায় মহিলা পরিচয় বেশি বিবেচিত হয়। এটা একটা সামাজিক সমস্যা।’’
এএমএ-এর প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের প়ড়াশোনা এবং প্রশিক্ষণের পরে কয়েক হাজার পুরুষ ও মহিলা চিকিৎসকের মানসিক চাপের পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করা হয়। দেখা গিয়েছে, তাঁদের চাপ প্রায় এক থাকে। কিন্তু কাজে যোগ দেওয়ার পরে পরিবর্তন আসে। পুরুষ চিকিৎসকদের তুলনায় মহিলা চিকিৎসকদের অবসাদ অনেক বেশি হয়।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, মহিলাদের পারিবারিক চাপ বেশি। চিকিৎসা পেশার সঙ্গে যুক্ত মহিলারাও ব্যতিক্রম নন। কিন্তু কর্মক্ষেত্রেও রোগীদের কাছে মহিলা চিকিৎসকেরা অনেক বেশি হেনস্থা হন। যা তাঁদের মানসিক অবসাদ বাড়ায়।
এ প্রসঙ্গে কার্ডিওথোরাসিক সার্জেন সুশীলা মিত্র বলেন, ‘‘এই বিষয় নিয়ে প়ড়ার সময় অনেকেই বলতেন এই অস্ত্রোপচারে অনেক সময় লাগে, আমি পারব কি না। পরিবার, সন্তানের কথা ভেবেই হয়তো ওই কথাগুলো শুনতে হত। বিদেশে পড়তে গিয়ে দেখেছিলাম, সেখানেও এই বিভাগে ছাত্রীর সংখ্যা খুব কম। তবে ভাল কাজ করতে পারলে সহকর্মী, রোগী সকলের বিশ্বাস অর্জন করা যায়। তবে সেই রাস্তা সহজ নয়।’’
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ক্যানসার বিভাগের চিকিৎসক সুপর্ণা ঘোষের কথায়, ‘‘মহিলা চিকিৎসককে দেখলে অনেক রোগী প্রথমে তাঁকে নার্স ভাবেন। পুরুষ চিকিৎসকের সঙ্গে কিন্তু এই ভুল হয় না। হয়তো ‘ডাক্তারবাবু’ কথাটা বেশি পছন্দের। তবে মহিলা চিকিৎসকদের প্রতি রোগীর বেশি প্রত্যাশা থাকে। মহিলা, তাই তিনি স্নেহপরায়ণ হবেন। অনেক ক্ষেত্রেই ‘মহিলা’ পরিচয় চিকিৎসকের পরিচয় ছাপিয়ে যায়।’’
অভিযোগ, হাসপাতালে রাতে মহিলা চিকিৎসক দায়িত্বে থাকলে বহু ক্ষেত্রে রোগীর পরিজনেরা তাঁকে হেনস্থার চেষ্টা করেন। যেমন, সম্প্রতি ঢাকুরিয়ার বেসরকারি হাসপাতালে রাতে এক মহিলা চিকিৎসক দায়িত্বে ছিলেন। অভিযোগ, এক রোগীর পরিজনেরা তাঁকে নানা ভাবে হেনস্থার চেষ্টা করেন। রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে নিগ্রহের মাত্রাও বাড়ে।
এ প্রসঙ্গে আইএমএ রাজ্য শাখার মহিলা উইংয়ের সম্পাদক চিকিৎসক সোনালি মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘চিকিৎসক মহিলা, তাই হেনস্থা করা সহজ, এই ভাবনা দুর্ভাগ্যজনক। এখন এই ধরণের ঘটনা বেশি ঘটছে।’’