খাঁচা পাতা হয়েছিল। কিন্তু শেয়াল সেই ফাঁদে পা দেয়নি।
খাঁচায় জ্যান্ত মুরগি রেখে লোভ দেখানোর চেষ্টা হয়েছিল। খাঁচার বাইরে থেকেই সেই মুরগি সাবাড় করে পালিয়ে গিয়েছে ধূর্ত শেয়ালের দল। তাদের গর্তে ধোঁয়া দিয়েও কোনও লাভ হয়নি।
অথচ, মাত্র আট দিনে কলকাতা বিমানবন্দরের ভিতরে স্রেফ তাড়া করে ২০টি শেয়াল ও তিনটে বনবেড়ালকে ধরে ফেলেছেন চেন্নাই থেকে আসা ২০ জন যুবক। প্রত্যেকেরই বয়স ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। চনমনে, তরতাজা। কাজে নামার আগে জনা তিনেকের রক্ত পরীক্ষা করে দেখা যায়, তাঁদের এক-এক জনের হিমোগ্লোবিন ১৮-১৯। এ বিষয়ে হেমাটোলজিস্ট প্রান্তর চক্রবর্তী বলেন, ‘‘শরীরে হিমোগ্লোবিন বেশি থাকলে অক্সিজেনও বেশি থাকে। তাতে চনমনে ভাবটা যেমন বাড়ে, তেমনই এর থেকে স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিও বাড়ে।’’
বিমানবন্দর সূত্রের খবর, শেয়াল ধরতে আসা ওই যুবকেরা তামিলনাড়ুর ‘নারিকুরাভা’ জনজাতির লোক। আদতে আদিবাসী ও শিকারি। শেয়াল ধরতে ওস্তাদ।
গত ডিসেম্বরে ওই যুবকেরা কলকাতায় এসে এখানকার ঢোল আর মাছ ধরার জাল কেনেন। বিমানবন্দরের পুরনো টার্মিনালে রাত কাটিয়ে, কাছেই ইডলি-দোসার দোকান থেকে খাবার খেয়ে প্রতিদিন চারটি দলে ভাগ হয়ে শেয়াল ধরতে নেমে পড়ছিলেন ওঁরা। কেউ খালি পায়ে, কেউ আবার হাওয়াই চটি পরে তাঁরা পৌঁছে যাচ্ছিলেন ঘাস-জঙ্গলে। হাঁটু পর্যন্ত গোটানো সাদা লুঙ্গি। গায়ে গেঞ্জি। কারও হাতে জাল, কারও হাতে ঢোল। বনবাদাড়ে ঢুকে মুখ থেকে অদ্ভুত এক আওয়াজ বার করতেন তাঁরা। সঙ্গে বাজত ঢোল। ওই আওয়াজ শুনেই নাকি গর্তের ভিতরে লুকিয়ে থাকা ধূর্ত শেয়ালেরা ভয় পেয়ে বাইরে বেরিয়ে আসছিল। তখন তাদের তাড়া করে জালে বন্দি করে ফেলছিলেন ওই যুবকেরা। তাঁদের গতি নাকি শেয়ালকেও মাঝেমধ্যে হার মানায়। শেয়ালগুলিকে ধরার পরে বন দফতরের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
কারা এই নারিকুরাভা তামিলে ‘নারি’র অর্থ শেয়াল। ‘কুরাভা’র অর্থ আদিবাসি জনজাতি। শিকারই এঁদের মূল জীবিকা। শেয়াল শিকারে এঁরা বিশেষ পারদর্শী। এক সময়ে শেয়ালের চামড়া ও দাঁত বিক্রি করতেন তাঁরা। বন্যপ্রাণী শিকার বন্ধ হওয়ায় জীবিকায় টান পড়ে। শহরে এসে অন্য ধরনের কাজে যুক্ত হন। অভিযোগ, সমাজবিরোধী কাজেও লিপ্ত হচ্ছেন তাঁদের একাংশ। ২০০৮ সালে তামিলনাড়ু সরকার এঁেদর উন্নয়নের জন্য পৃথক পর্ষদ গঠন করেছে।
বিমানবন্দর সূত্রের খবর, রানওয়ের পশ্চিম দিকে প্রচুর ঘাস-জঙ্গল ও গাছপালা রয়েছে। সেখানে বহু শেয়ালের বাস। সাপ থেকে শুরু করে ইঁদুর— সবই খায় শেয়ালেরা। এ ছাড়া, বিমানবন্দরের পাঁচিলের বাইরের দিকে আবর্জনা থেকেও খাবার জুটে যায় তাদের।
পথ ভুলে ওই শেয়ালেরা মাঝেমধ্যেই চলে আসে রানওয়ের কাছে। যাত্রীদের নিয়ে কলকাতায় নামার সময়ে রানওয়ের উপরে শেয়াল দেখে বহু বার বিমান নিয়ে আবার উড়ে যেতে হয়েছে পাইলটকে। কারণ, বিমান নামার সময়ে কোনও ভাবে শেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে বড়সড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকে যায়। শুধু শেয়াল নয়, এখন মাঝেমধ্যে কুকুরও দেখা যাচ্ছে রানওয়ের কাছে। বিমানবন্দর সূত্রের খবর, শেয়াল-কুকুর নিয়ে প্রতি মাসে পাইলটদের অন্তত ১০-১২টি অভিযোগ জমা পড়ে। কুকুরদের সহজে ধরা যায়। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও এত দিন শেয়াল আটকানো যায়নি।
বিমানবন্দরের প্রাক্তন কর্তা স্বামীনাথন চেন্নাইয়ে ‘নারিকুরাভা’-দের খোঁজ পেয়ে যোগাযোগ করেন কলকাতার সঙ্গে। শুক্রবার ফোনে তিনি জানান, গত অক্টোবরে ওই প্রজাতির দুই দলনেতাকে ট্রেনে কলকাতায় নিয়ে আসেন তিনি। তাঁরা বিমানবন্দরের ভিতরে ঘুরে দেখেন। পরে ডিসেম্বরের শেষে ২০ জনের দলটি আসে।
‘নারিকুরাভা’রা চলে যাওয়ার পরে দৃশ্যতই শেয়াল কমে গিয়েছে। তবে, দিন কয়েক আগে এক পাইলট নাকি জানিয়েছেন, রানওয়ের পাশে তিনটে শেয়ালকে একসঙ্গে দেখেছেন তিনি! শোনা গিয়েছে, আবার ডাক পড়তে পারে ‘নারিকুরাভা’-দের।
অঙ্কন: কুনাল বর্মণ