—প্রতীকী ছবি
আলোয় ভাসছে রাস্তাটা। কিন্তু গাড়িগুলোর নড়ার কোনও লক্ষণ নেই।
কলকাতার রাজপথকেই তখন যুদ্ধক্ষেত্র মনে হয় বাবুসোনা দাসের। সিগন্যাল আর ট্র্যাফিকের প্রতিপক্ষকে কাত করে এগোতে গিয়ে হাতছানি দেয় মেয়েটার মুখ।
তুলোর পুঁটলিটা ঘরে আসার পরে প্রথম পুজো! এমনিতে তো রাত দেড়টাতেও পাড়া জাগিয়ে রাখে। ‘রাত দুটোয় তোর বাবা ফেরা অবধি জাগতে পারবি না!’
পুজোয় একটা দিনও ছুটি নেই রেস্তরাঁর খাবার সরবরাহের ‘বাইকসেনাদের’। বেলা ১১টা থেকে রথ ছোটাও। শুধু পুজো নয়, স্বাধীনতা দিবস, বড়দিন— এটাই নিয়ম।
উৎসবের শহরে তাই গড়ে ওঠে অভিনব কর্মযোগের তত্ত্ব! শহর জুড়ে ছড়ানো চিনে রেস্তরাঁর কাটজুনগর ইউনিটের ম্যানেজার রবিউল হাসান হাসিমুখে বোঝান। ধরুন, আজ ১৫ অগস্ট। ‘বাইকবয়’-এর মা জানবেন, ছেলে বাড়ি থাকবে না! কিংবা পরশু, অষ্টমীর পুজো। ‘বাইকবয়’-এর বৌ কিন্তু জানেন, বরবাবাজি রাত দেড়টা-দু’টোর আগে ফিরলে সূর্য পশ্চিম দিকেও উঠতে পারে! মনটা এই ভাবে তৈরি করতে হয়। কলকাতায় খাবার সরবরাহের চারটি অ্যাপ পরিষেবায় কাজ করেন হাজার দশেক বাইক-আরোহী। রেস্তরাঁগুলোর নিজস্ব টিম ধরলে আরও দু’তিন হাজার। রোদে-জলে-বৃষ্টিতে-পুজোয় টানা ঘণ্টা ১২ প্রাণপাত করার পরে বখশিস-উপরি ধরেও মাস গেলে গড় রোজগার ১০-১২ হাজার। একটি অ্যাপ সংস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন সদ্য শ্রম কমিশনারের দরবার অবধি গড়িয়েছে। তুলনায় সরাসরি রেস্তরাঁর চাকরিতে মাইনের ণত্ব-ষত্ব থাকে বলে মনে করেন বাবুসোনা-সোমনাথ-সুজয়রা।
তবে অ্যাপের চাকরিতে পুজোর দিনে কেউ সন্ধের পরে লগ-অফ করে কেটে পড়তেই পারেন। যদিও ফাঁকি দিলে বোনাস-ইনসেনটিভ মার খেতে পারে! বাইকবয়দের সে সুযোগ নেই। তাই মনটা তৈরি করা জরুরি। ‘‘ছুটি ব্যাপারটা কিন্তু মনের ভাব আসলে! ক্যালেন্ডারের উপরে নির্ভর করে না।’’— নিপাট দার্শনিক রবিউল।
আলো, মণ্ডপ, ভিড় কাটিয়ে শহরময় টো টো কোম্পানিতে তাই বিচিত্র অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরে। খিদে পেটে লোকের মেজাজ তিরিক্ষি থাকে, তার সঙ্গে ‘সান্ধ্য আহ্নিক’-এর তুরীয় মেজাজ। দমদমের কার্তিক হালদার হাসেন, ‘‘বিজয়ায় কেউ ঘরে বসিয়ে মিষ্টি খাইয়েছেন, আবার দেরির জন্য সপ্তমীতে সল্টলেকের এক জন বাইকের চাবি কেড়ে নিয়েছিলেন!’’ দু’বছর আগের নবমী। কলকাতা ভাসছে! যোধপুর পার্কে গ্যারাজের কোমরজল ঠেলে পাঁচতলায় উঠলেন ‘ডেলিভারি বয়’! সে দিন একসঙ্গে চারটে অর্ডারের প্যাকেট কোলের শিশুর মতো বুকে আগলে নিয়েছিলেন সৌমেন মান্না। ‘‘বাইকের বক্সে প্যাকেটগুলো রাখতে সাহস হয়নি। পুজোর দিন, লোকের মতিগতির ঠিক নেই!’’
বাবুসোনার স্ত্রী শম্পার মুখে শোনা গেল বিয়ের পরের প্রথম পুজোর কথা! নতুন টপ, জিন্সে সেজে ঘরে বসে বসেই রাত দুটো। ঘেমেনেয়ে তখন ঢুকছেন বীরপুরুষ! ‘ইউনিফর্ম’ পাল্টে চান সেরে নতুন পোশাকে সাজেন যুবক। নতুন বৌকে বাইকে নিয়ে যেন হাওয়ায় সাঁতার! মণ্ডপে মায়ের মুখটা কখনও এত সুন্দর লাগেনি শম্পার।
ছুটি আসে টায়েটোয়ে চলা হিসেবি সংসারে! নিম্নবিত্ত গেরস্থালি ছুটির আলোয় আলোময়!