এক যুগ আগের কথা। পোস্তার দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিটে ডোকরা শিল্পের কাজ দেখিয়ে নজর কেড়েছিলেন এক নবীন শিল্পী। আবার বছর কয়েক আগে হাতিবাগানের নবীনপল্লিতে শিল্পী কমলদীপ ধরের চদরবদর দেখতে উপচে পড়েছিল ভিড়।
হোক না শহুরে পুজো, তবু ভিড় টানতে প্রতি বছরই রাজ্য বা দেশের প্রত্যন্ত এলাকার লোকশিল্পের উপরেই ভরসা করেন থিম-শিল্পীদের একটি বড় অংশ। বছরভর খুঁজে-পেতে উৎসবে তুলে নিয়ে আসেন সেই সব শিল্পকে।
বহু বছর ধরে চলে আসা শিল্পীদের এই রীতি বজায় থাকছে এ বারও। উত্তর থেকে দক্ষিণ— একাধিক শিল্পী মণ্ডপ সাজাতে বেছে নিয়েছেন লোকশিল্পকেই।
যেমন অনির্বাণ দাস। হরিদেবপুর অজেয় সংহতির মণ্ডপ সাজাতে তিনি এ বার বেছে নিয়েছেন ছো শিল্পকে। ছো নাচের আদলে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে রামায়ণের গল্প। ছোটখাটো মুখোশের পাশাপাশি থাকছে ২৫-৫০ ফুটের মুখোশও। মণ্ডপে ঢুকে আপনার মনে হবে যেন আপনি ঢুকেছেন কোনও ছো নাচের আসরে। বড়িশা ক্লাবে তরুণ দে আবার মণ্ডপ সাজানোর জন্য বেছে নিয়েছেন কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুলকে। নাচের নানা ভঙ্গিকেই ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে সেই সব পুতুলে।
হিন্দুস্থান পার্ক সর্বজনীনের থিম আবার ‘মেলা’। সেখানে শিল্পী প্রশান্ত পাল মণ্ডপ সাজাচ্ছেন পুতুল, হাত পাখা, লক্ষ্মীর সরা আর খেলনা ঝুমঝুমি দিয়ে। বাংলার এই সব লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ শিল্প দিয়ে সাজিয়েই মা দুর্গাকে আহ্বান জানানো হচ্ছে দক্ষিণ কলকাতার ওই পুজো প্রাঙ্গণে।
দমদমের বসাক বাগানে সরাসরি লোকশিল্পকে তুলে না আনলেও জঙ্গলমহলের ঘাসশিল্পকে হাতিয়ার করেছেন অনির্বাণ। মণ্ডপ সাজছে ঘাসফুলের মঞ্জরীতে। দমদম পার্ক তরুণ দলে আবার উঠে আসছে চড়কের মেলা। মেলা সাজাতে অনির্বাণ ব্যবহার করছেন ডুগডুগি, তালপাতার সেপাইকে।
উত্তরের শিকদারবাগানের পুজোয় এ বার মণ্ডপ সাজিয়ে তুলছেন শিল্পী মানস রায়। এ রাজ্যের সীমা পেরিয়ে অন্ধ্রপ্রদেশের তোলু বোম্মলতাকে। সেটা কী? শিকদারবাগানের পুজোকর্তারা বলছেন, অন্ধ্রপ্রদেশের অনন্তপুরা জেলায় রাখাল ছেলেরা চামড়া দিয়ে পুতুল তৈরি করে। সেই শিল্পেরই নাম তোলু বোম্মলতা। তবে পুজো মণ্ডপে মানস পুতুল গড়ছেন চামড়ার বদলে বিশেষ ধরনের কাগজ দিয়ে।
দেশের বাইরে থেকে লোকশিল্পকে তুলে এনেছেন শিল্পী দীপক ঘোষও। যোধপুর পার্কের পুজোয় তিনি তুলে ধরছেন আফ্রিকার উপজাতির শিল্পের আদল। দমদম পার্ক তরুণ সঙ্ঘে অমর সরকার তুলে আনছেন নর্মদার পাড়ে বসবাসকারী উপজাতির শিল্প। মাটি, কাপড়, বাঁশের পাশাপাশি মণ্ডসপসজ্জার উপকরণে আছে আয়না। সন্তোষপুর ত্রিকোণ পার্কের মণ্ডপে তুলে আনা হচ্ছে আফ্রিকার এক উপজাতীয় লোকশিল্পকে। সেখানে দেখা যাবে গোবরের পুতুল। মানুষ মণ্ডপে ঢুকেই হারিয়ে যাবেন আফ্রিকার গ্রামে।
লোকশিল্পকে হাতিয়ার করে কোমর বেঁধেছেন মহিলা শিল্পীরাও। সন্তোষপুর লেকপল্লির শিল্পী অদিতি চক্রবর্তী তুলে আনছেন রাজস্থানের লোকশিল্প মান্ডানা, কর্নাটকের লোকশিল্প চিত্তারাকে। মূলত সাদা-কালো রঙে এই শিল্প ওই রাজ্যের আদিবাসী মহিলারা বাড়ির দেওয়ালে করেন। ওয়েলিংটন ব্যবসায়ী সমিতির পুজোয় আবার অদিতি তুলে এনেছেন গুজরাতি লোকশিল্প মাতানি পাচেড়ি, পিথোরা, মোচিকে।