ফাঁকা: বৃহস্পতিবার দুপুরে পার্ক সার্কাস সাত মাথার মোড়। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
বন্ধের শহর?
এক ঝলক দেখলে তেমনটাই মনে হতে পারে! এতই ফাঁকা রাস্তাঘাট। হাতে গোনা লোকজন। দোকানপাট বন্ধ। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা অবিশ্বাস্য রকম কম। যার ফলে শহরের গতি এ দিন হঠাৎই বেড়ে গিয়েছে। যে দূরত্ব পার হতে অন্য দিন সময় লাগে এক ঘণ্টা, এ দিন তা অনায়াসে পাড়ি দেওয়া গিয়েছে ২০ মিনিটে।
কারণ?
ফাঁকা শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন ধনেশ যাদব। পেশায় মোটবাহক। স্টেশনের ঘড়িতে তখন বিকেল পৌনে ৪টে। তাঁর তখনও ‘বউনি’ হয়নি। কিছুটা শ্লেষ, কিছুটা হতাশার স্বরে ধনেশ বলছিলেন, ‘‘গিনতি চল রাহা হ্যায় বাবু! গিনতি চল রাহা হ্যায়! ইস লিয়ে আদমি লোগ নেহি হ্যায় রাস্তেমে।’’ অর্থাৎ ভোট গণনা চলছে। তাই রাস্তায় লোকজন নেই।
ধনেশের মতো ‘দিন আনি, দিন খাই’ মানুষের হতাশার কারণ আছে। কারণ, বৃহস্পতিবার ভোটের ফলপ্রকাশের দিন কলকাতা যেন ‘নিঃসঙ্গপুর’। যা দেখে হালকা রসিকতাও শোনা গিয়েছে পথে, ‘ফণীর সময়েও এত ফাঁকা ছিল না চার দিক, যা এ দিন হল!’
এ দিন বেলা সামান্য গড়াতেই মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে যায় ফলাফলের ছবিটা। তার পরে দিনের শুরুতে শহরের মুখে যে কুলুপ পড়েছিল, দিনের শেষেও তাতে বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম ঘটল না। জয়োল্লাস, আবির, বোমা ফাটানো মূলত ছিল চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের উপরে বিজেপি অফিসের সামনে। বিকেলের পরে কিছুটা কালীঘাটে। যদিও অন্যবারের তুলনায় তা চোখে পড়ার মতো কম। কিন্তু বাকি শহর, শ্যামবাজার থেকে যাদবপুর পর্যন্ত রাস্তায় কোথাও প্রকাশ্যে কোনও দলের তরফেই তেমন বিজয়ধ্বনি শোনা যায়নি, ওড়েনি আবির। এ এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য!
ঢাকুরিয়ার গাঙ্গুলিপুকুরের চায়ের দোকানদার বিশ্বজিৎ মণ্ডল বলছিলেন, ‘‘বন্ধেও এর থেকে বেশি লোক থাকে রাস্তায়। অন্য কেউ দোকান খোলেননি। আমিই খুললাম। এখন দেখছি, না খুললেই ভাল হত। বলতে গেলে বিক্রিই হয়নি।’’ গড়িয়াহাট রোডের দোকানদার বাপি মল্লিক আবার তড়িঘড়ি দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন। বললেন, ‘‘কী করব? লোকজনই তো নেই।’’
‘‘আসলে সকলে ভয় পেয়েছে বেরোতে। কী না কী হবে, তাই আর ঝুঁকি নেয়নি’’— বলছিলেন ট্যাক্সিচালক সতীশ শাহ। বিহারের বাসিন্দা সতীশ যোধপুর পার্কে ভাড়া থাকেন। তাঁর পরিবার-পরিজনেরা থাকেন বিহারেই। গত পাঁচ বছর ধরে শহরে থাকা সতীশের কথায়, ‘‘শেষ কবে এত ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি চালিয়েছি মনে করতে পারছি না।’’
শহরের যানজট-দীর্ণ রাস্তার মোড়গুলি, সে শ্যামবাজারই হোক বা মানিকতলা মোড় অথবা মৌলালি-পার্ক সার্কাস, এক লহমায় পার হওয়া গিয়েছে সমস্ত পথ। এন্টালি মার্কেটের ব্যবসায়ী সোনু সাউ বলেন, ‘‘অন্য দিন এই জায়গাটা ভিড়ে গিজগিজ করে। আজকে তো মাছি উড়ছে! দেখছেন না, অনেক দোকানও বন্ধ।’’
কলকাতা পুরসভার ই-সেন্টারে সম্পত্তিকর জমা দিতে গিয়েছিলেন যাদবপুরের বাসিন্দা অসিত মণ্ডল। অসিতবাবু বলছিলেন, ‘‘আমার আগে মাত্র দু’জন লাইনে ছিলেন। অন্য সময়ে এত ভিড় হয় যে, এসি চালিয়ে লোকজনকে বসাতে হয় অফিসের ভিতরে।’’ কলকাতা পুরসভা সূত্রের খবর, অন্য দিন মাসের এই সময়ে দিনে যেখানে করদাতার সংখ্যা কমপক্ষে ১০ হাজার থাকে, এ দিন সারা শহরে সম্পত্তিকর জমা দিতে সেখানে এসেছিলেন মাত্র সাড়ে চার হাজার। অর্থাৎ, অর্ধেকেরও কম।
ফাঁকা শহরের রাস্তায় যে ক’জন গোনাগুনতি লোক ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশেরই চোখ ছিল মোবাইলে। অন্য দিনও থাকে অবশ্য। তবে এ দিন মোবাইল স্ক্রিনে চোখ ছিল ফলাফলের উপরে। যদিও একান্ত নিজস্ব বৃত্ত ছাড়া কেউই সেই ফল নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করেননি। শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনের বাইরে অটোর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা যুবককে তাঁর বান্ধবী প্রশ্ন করলেন, ‘‘ক’টা হল?’’ যুবকের উত্তর, ‘‘আর জেনে কী করবে?’’ অটোচালক শুনে ফেলেছিলেন তাঁদের কথোপকথন। তিনি শুধু বললেন, ‘‘ভোটে যে-ই জিতুক দাদা, মানুষকে গুরুত্ব দিতে হবে। না হলে কত তো দেখলাম এত বছরে। যারাই মানুষকে গুরুত্ব দেয়নি, সব তলিয়ে গিয়েছে।’’
ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা পৌনে ৬টা। দূরে কোথাও থেকে বাজি ফাটার আওয়াজ ভেসে আসছে। ম্রিয়মাণ হয়ে থাকা শহরে যেন ঝাঁকুনি লাগল হঠাৎ। ‘মানুষকে গুরুত্ব দিতে হবে’—ওই অটোচালকের বলা কথাগুলো ধীরে ধীরে তখন মিশে যাচ্ছে দূরের বিজয়-ধ্বনির সঙ্গে।