রাস্তার গাড়ি দাঁড় করানোর অপরাধে ‘প্রহৃত’ বিজ্ঞানী

অতি সামান্য এক ঘটনা। রাস্তার পাশে মিনিট দুয়েকের জন্য গাড়ি দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন বোস ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী শুভ্রাংশু চট্টোপাধ্যায়। তার জেরে কপালে জুটল গালাগাল, এমনকী মারধরও।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৬ ০২:৫৩
Share:

শুভ্রাংশু চট্টোপাধ্যায়

অতি সামান্য এক ঘটনা। রাস্তার পাশে মিনিট দুয়েকের জন্য গাড়ি দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন বোস ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী শুভ্রাংশু চট্টোপাধ্যায়। তার জেরে কপালে জুটল গালাগাল, এমনকী মারধরও।

Advertisement

মঙ্গলবার রাতে জনা পাঁচেক যুবকের এ হেন আচরণে বিস্মিত সাউথ সিঁথির বাসিন্দা ৩৭ বছরের ওই বিজ্ঞানী। সিঁথি থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন তিনি। তবে বুধবার রাত পর্যন্ত ওই ঘটনায় কেউ গ্রেফতার তো হয়ইনি, উল্টে কারা এমন ঘটিয়েছে— সে বিষয়েও পুলিশ একেবারে অন্ধকারে।

‘জোর যার মুলুক তার’-এর এই সময়কালে টালা থেকে টালিগঞ্জে এ ভাবেই ‘দাদাগিরি’র শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। পাড়ার মোড়ে-মোড়ে স্বঘোষিত ‘দাদা’র দল শাসন করছে নিজস্ব নিয়মে, পুলিশ-প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। দেখা গিয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই যুবকদের মাথায় স্নেহের হাত রয়েছে শাসক দলের স্থানীয় নেতা-নেত্রীর। ‘ছোট ছেলে ভুল করে ফেলেছে’ গোছের আস্কারায় এই যুবকেরা কার্যত আইন নিজেদের হাতে তুলে নিচ্ছে বলে অভিযোগ। কখনও সিন্ডিকেটের নামে তার জেরে অতিষ্ঠ হচ্ছেন ব্যবসায়ী। কখনও আক্রান্ত হচ্ছে খোদ পুলিশ।

Advertisement

কলকাতা পুরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের সাউথ সিঁথি রোডের কাঠগোলা এলাকায় মঙ্গলবার রাতের এই ঘটনার বিষয়ে তাঁর কিছুই জানা ছিল না বলে দাবি করেছেন ডিসি (নর্থ) শুভঙ্কর সিংহ সরকার। বুধবার সন্ধ্যায় ফোন করা হলে তিনি জানান, বিষয়টি সংবাদমাধ্যমের থেকেই শুনলেন। শুভঙ্করবাবু বলেন, ‘‘বিষয়টি দেখা হচ্ছে।’’ তবে স্থানীয় কাউন্সিলর তৃণমূলের পুষ্পালী সিংহ বলেন, ‘‘একটা মারামারির খবর শুনেছি। তবে এ ভাবে মারধর করা একেবারেই ঠিক হয়নি। তবে কারা এ কাজ করেছে, তা ঠিক চিহ্নিত করতে পারছি না।’’ অভিযুক্তেরা কারা, রাত পর্যন্ত স্থানীয় সূত্রেও তা জানা যায়নি।

কী ঘটেছিল মঙ্গলবার রাতে?

শুভ্রাংশু জানান, রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ অফিস থেকে বেরিয়ে নিজের গাড়িতে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন চালক। পথে স্ত্রীর ফোন পেয়ে ৯টা নাগাদ বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে কাঠগোলা এলাকায় রাস্তার ধারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে শুভ্রাংশুবাবু চালককে পাশের মুদি দোকান থেকে একটি জিনিস কিনে আনতে বলেন। তাঁর অভিযোগ, গাড়ি দাঁড় করানো মাত্রই বছর পঞ্চান্নর এক ব্যক্তি এসে বলেন, ‘এখানে গাড়ি রাখা যাবে না।’ শুভ্রাংশুবাবু বলেন, ‘‘ওঁর বারণ শুনেই গাড়িটি পিছনের দিকে সরিয়ে নিচ্ছিলাম। তাতে ওই ব্যক্তি ফের আপত্তি করলে আমি অনুরোধ করে বলি, মাত্র দু’মিনিটের জন্য গাড়ি দাঁড় করাতে দিন।’’

ওই বিজ্ঞানীর অভিযোগ, এর পরেই ওই ব্যক্তি অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করেন। কারণ জানতে চেয়ে তখন গাড়ি থেকে নেমে আসেন তিনি। শুভ্রাংশু বলেন, ‘‘আমি ওই ব্যক্তিকে বলি, অযথা কেন খারাপ কথা বলছেন?’’ তাঁর অভিযোগ, এর পরেই দূরে থাকা কয়েক জন যুবক এগিয়ে এসে হম্বিতম্বি শুরু করেন। এমনকী কোনও কথা না শুনেই তাঁকে মারধরও শুরু করে ওই দলটি। শুভ্রাংশু বলেন, ‘‘ওই যুবকেরা পাল্টা দাবি করেন, আমি ওই ব্যক্তিকে মারতে যাচ্ছিলাম। আমি ওঁদের বোঝাতে থাকি, উনিই গালিগালাজ করছেন। কিন্তু কেউ কোনও কথা না শুনে মারধর চালিয়ে যেতে থাকেন। টানা ১০ মিনিট এমন চলার পরে পথচলতি কয়েক জন এসে ওঁদের আটকান। তাঁরাই এসে আমাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে যান।’’

শুভ্রাংশুর অভিযোগ, এই ঘটনা চলাকালীন রাস্তায় টহলদার পুলিশের মোটরবাইকের দেখা মেলেনি। তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ তো দূর অস্ত্‌। রাস্তার ধারে অনেকেই দাঁড়িয়ে দেখছিলেন যে, ওঁরা আমাকে মারছেন। পরে কয়েক জন এগিয়ে এসে আটকান।’’ তিনি আরও জানান, গাড়িতে ওঠার পরেও ওই যুবকেরা হুমকি দিচ্ছিলেন, ‘জানি কোথায় থাকে। চিনে রাখলাম।’

ওই বিজ্ঞানী জানান, বাড়িতে ফিরে ডান চোখে খুব ব্যথা অনুভব করেন তিনি। স্ত্রী ও মাকে পুরো বিষয়টা জানান। এর পরেই পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে বুধবার সকালে সিঁথি থানায় গিয়ে জেনারেল ডায়েরি করেন ওই বিজ্ঞানী। শুভ্রাংশু বলেন, ‘‘পুলিশ আমাকে জানিয়েছে, ওই মুহূর্তে কারা ওখানে ছিল তা বোঝা সম্ভব নয়।’’

সামান্য একটা গাড়ি রাখার বিষয় নিয়ে এত বড় ঘটনা ঘটতে পারে, তা এখনও মানতে পারছেন না শুভ্রাংশু। শুধু বলছেন, ‘‘খুব ভয় হচ্ছে জানেন! বাড়িতে স্ত্রী, ছেলে থাকে।’’

ঘটনাস্থল থেকে কয়েকশো মিটার দূরেই ‘বাসন্তী ভিলেজ’ আবাসনে গত ২০১৩ সাল থেকে সপরিবার থাকেন ওই বিজ্ঞানী। কর্মসূত্রে বেশ কয়েক বছর বিদেশে কাটিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘বিদেশে কত সম্মান পেয়েছি। মানুষ কত ভাল ব্যবহার করেছেন। আর নিজের দেশে মঙ্গলবারের এই ঘটনার পরে সারারাত ভেবেও বুঝতে পারিনি, আমার অপরাধ কী ছিল?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন