লোহালক্কড়ের মাঝে পড়ে এক চিলতে ইতিহাস

ইতিহাসের রক্ষণাবেক্ষণে পেশাদারিত্বের অভাব রয়েছে। কারখানার বর্তমান সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার রাজীব চক্রবর্তীও বলছিলেন, ‘‘এত ইতিহাস লোকচক্ষুর বাইরেই রয়ে গিয়েছে!

Advertisement

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০২:৩০
Share:

অস্ত্রশালা: সংগ্রহশালায় আছে এমনই কামান, রকেট লঞ্চার ও অন্যান্য অস্ত্রের সম্ভার। নিজস্ব চিত্র।

নতুন নির্মাণের জন্য ভিত খোঁড়া চলছিল। কোদাল, গাঁইতির ঘায়ে ঠং আওয়াজ হতেই চমকে উঠেছিলেন শ্রমিকেরা। খবর গেল কাশীপুর গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরির কর্তাদের কাছে। মাটি খুঁড়ে বার করে আনা হল ধাতব জন্তুটিকে। সিংহ ও ঘোড়ার মিশেলে তৈরি হওয়া সেই অদ্ভুত প্রাণীর মূর্তিকে সাফসুতরো করে রাখা হল জেনারেল ম্যানেজারের অফিসের সামনে।

Advertisement

আপাতদৃষ্টিতে নিছক কল্পনা মনে হলেও ইতিহাসবিদদের একাংশের মতে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতীক হিসেবে যে সিংহ ও ঘো়ড়া দেখা যায়, তাকেই জুড়ে এই ‘হাঁসজারু’ মূর্তি হয়েছিল। হবে না-ই বা কেন, কোম্পানি আমল থেকে কলকাতার উপকণ্ঠে কাশীপুর ছিল ঔপনিবেশিক শাসকদের অস্ত্রের মূল জোগানদার। দুই শতক পেরোনো কলকাতার এই অস্ত্র কারখানার অন্দরে ইতিহাসের ছড়াছড়ি।

সেই ইতিহাস নিয়ে যায় মুঘল আমলেও। কারখানার অন্দরে সংগ্রহশালায় রয়েছে এক়টি পুরনো কামান। গায়ে খোদাই করা পারস্য লিপি দেখে অনুমান, সেটি মুঘল যুগের। কোম্পানি বাহাদুরের আমলে কী ভাবে তা কাশীপুরে পৌঁছেছিল তা আজও অজ্ঞাত। রয়েছে ফরাসি ভাষায় খোদাই করা একটি পুরনো ধাতব দরজা।

Advertisement

কিন্তু ইতিহাসের রক্ষণাবেক্ষণে পেশাদারিত্বের অভাব রয়েছে। কারখানার বর্তমান সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার রাজীব চক্রবর্তীও বলছিলেন, ‘‘এত ইতিহাস লোকচক্ষুর বাইরেই রয়ে গিয়েছে! তাই এ সব সরিয়ে দমদম রোডে নতুন সংগ্রহশালা গড়া হবে। শুধু অস্ত্র কারখানা নয়, কাশীপুর-বরাহনগরের আঞ্চলিক ইতিহাসও থাকবে সেখানে।’’ সত্যিই তো, কারখানা তো শুধু লোহালক্কড়, যন্ত্রপাতি নিয়ে নয়। ওই এলাকা, শ্রমিক বস্তি, কাছের চিতু ডাকাতের কালীবাড়ি, রামকৃষ্ণদেবের উদ্যানবাটী— সবই তো মিশে রয়েছে। বছর কয়েক আগে কারখানার অদূরে গঙ্গার পাড়ে পাইপ বসাতে গিয়ে উঠে এসেছিল কামান। সেটি এখন টাউন হলে রাখা রয়েছে।

কোম্পানি আমলে ফোর্ট উইলিয়ামের ভিতরে একটা ছোট কারখানা ছিল। ১৮০১ সালে ফরাসিদের থেকে কাশীপুর গ্রাম কিনে শুরু হল নতুন কারখানা গড়া। এর পরে কত জল বয়ে গিয়েছে গঙ্গা দিয়ে। ১৮৩০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম থেকে অস্ত্র কারখানা সরে এল কাশীপুরে। চড়াই-উতরাই বেয়ে ১৯০৫ সালে নাম হল ‘গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরি’। বাঙালির কাছে, শুধুই ‘গান-শেল’।

সংগ্রহশালায় ঘুরতে ঘুরতেই ঢং করে ঘণ্টা বাজিয়ে দিলেন এক কর্মী। চমকে উঠতেই বললেন, সেই আমলে গঙ্গাই ছিল যাতায়াতের পথ। অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম আসার সময়ে নৌকায় সঙ্কেত পাঠাতে পাড়ে বাঁধা থাকত এই ঘণ্টা। জলপথে অস্ত্র কারখানা পরিদর্শনে আসতেন লর্ড কার্জন। নামতেন জেনারেল ম্যানেজারের বাংলোর জেটিতে। পুরনো সময়কে মনে করাতে রয়েছে কারখানার সদরে থাকা ‘ক্লক টাওয়ার’। বুড়িয়ে গিয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সেটি। হেলে গিয়েছিল স্তম্ভটিও। তার পুরনো চেহারা ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কলকাতার বৃদ্ধ ঘ়়ড়ির ‘ডাক্তার’ স্বপন দত্তকে দিয়ে সারানো হচ্ছে শতাব্দীপ্রাচীন অ্যাংলো-সুইস ঘড়িটিও।

স্বাধীন ভারতের ইতিহাসেও গুরুত্বপূর্ণ এই কারখানা। নেহরু আমলে অস্ত্রের বদলে ট্রাক্টর তৈরির বরাত মিলেছিল। ১৯৬২ সালে চিনের হামলার পরে ফের হাতিয়ার তৈরিতে মনোনিবেশ। কার্গিল যুদ্ধের এল-৭০ কামান কিংবা পাকিস্তানে ঢুকে ভারতীয় সেনার সাম্প্রতিক ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর অন্যতম হাতিয়ার রকেট লঞ্চারও এই কারখানায় তৈরি। সদ্য তৈরি করেছে মহিলাদের জন্য বিশেষ পিস্তল ‘অশনি মার্ক টু’।

বর্তমানে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরিতে বিদেশি লগ্নি আসছে। সে ক্ষেত্রে দেশের কারখানাগুলির কী হবে, তা নিয়ে চর্চা চলছে। এ সবের মধ্যেই ইতিহাসের হাত ধরে এগোতে চাইছে বাঙালির ‘গান-শেল’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন