ঐতিহ্য বহনকারী অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশনের সেই বাড়ি।
ইট-কাঠ-পাথরই কি শেষ কথা বলে? না কি সেই স্থাপত্যের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে আছে যে ঐতিহ্য আর আখ্যান, তা-ই শেষমেশ হয়ে ওঠে জীবন্ত?
বাইরে তখন ঝেঁপে বৃষ্টি নেমেছে। ঘরের ভিতর এই প্রতিবেদকের উল্টো দিকে বসে যিনি, তিনি তত ক্ষণে ডুবে গিয়েছেন স্মৃতিচারণে, ‘‘রোগাপাতলা চেহারার একটি লোক। উস্কোখুস্কো চুল। তাঁর একটি তথ্যচিত্র দেখে আমার বাবা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এতটাই ভাল লেগেছিল যে পরে সেই নবীন পরিচালকের সিনেমা প্রযোজনাও করেছিলেন বাবা।’’
যাঁর সঙ্গে আলাপচারিতার জন্য আসা, তিনি নিজেই এই প্রসঙ্গ তুললেন। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘জানেন, কে সেই পরিচালক? কোন ছবির কথা বলছি?’’ এক গাল হেসে আবার নিজেই বললেন, ‘‘সিনেমাটির নাম ‘অযান্ত্রিক’। পরিচালক ঋত্বিক ঘটক। অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশনের ব্যানারে এই ছবি মুক্তি পায়। আমার দাদু অনাদি বসু সেই কোম্পানিরই প্রতিষ্ঠাতা।’’
আরও পড়ুন, ‘সত্যজিৎবাবু পোশাকের ডিজাইন এঁকে দিলেন, আমি আব্বার কাছে পৌঁছে দিলাম’
লেনিন সরণির ওপরে অরোরা ফিল্ম-এর সেই ঐতিহ্যশালী বাড়িতে ‘দাদুর চেয়ারে’ বসেছিলেন নাতি অঞ্জন বসু। আবেগতাড়িত হয়ে অঞ্জন বললেন, ‘‘এখনও এই বাড়িটি অবিকল একই রকম। পুরনো চেয়ার, টেবিল, আলমারি— কিছুই বদলায়নি। দাদুর মৃত্যুর পরে বাবা দায়িত্ব নিলেন। তার পর আমি। তিন প্রজন্মের হাত ধরে অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশনের বয়স দেখতে দেখতে ১১৩ বছর হয়ে গেল!’’
অঞ্জনবাবু বললেন, ‘‘বিখ্যাত পরিচালক মৃণাল সেন আমাদের কোম্পানিতে ‘সাউন্ড’ বিভাগে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছিলেন! এখন ভাবলে অবাক লাগে। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ নিয়েও একটা গল্প রয়েছে।’’
১৯০৬ সালে ‘ম্যাজিক থিয়েট্রিকাল কোম্পানি’ নামে পথ চলা শুরু হয়।
জিজ্ঞেস করলাম, কী সেই গল্প?
অঞ্জনবাবু বললেন, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় এক দিন বাবাকে ডেকে বললেন, ছেলেটি খুব ভাল সিনেমা বানিয়েছে। আপনাকে কিন্তু পরিবেশনার দায়িত্ব নিতেই হবে। সেই পৃথিবী বিখ্যাত ভারতীয় ক্লাসিক সিনেমার ডিস্ট্রিবিউটরের দায়িত্ব নেয় অরোরা ফিল্ম কর্পোরেশন। এর পরের ইতিহাস সবাই জানেন।
প্রশ্ন করলাম, অরোরা ফিল্মের ব্যানারে শেষ বাংলা সিনেমা ‘দুরন্ত জয়’, তা-ও আবার ১৯৭৪ সালে?
কথা থামিয়েই অঞ্জন বলে উঠলেন, ‘‘এখন বাংলা ছবি মানেই তো ‘নকল’ সিনেমা। চিত্রনাট্যে সেই জোর নেই। এখনকার অনেক পরিচালক সিনেমা করার জন্য প্রযোজকদের কথায় ওঠেন বসেন। বাংলার সংস্কৃতির কথা ভুলে দক্ষিণের অথবা পাশ্চাত্যের সিনেমা হুবহু টুকে দেন। এমন সিনেমা করে লাভ কী?’’ তাঁর কথায়: ভাল সিনেমা করার জন্য উন্নতমানের স্টুডিও দরকার। আমাদের ১১৩ বছরের কোম্পানি সে লক্ষ্যেই এগোচ্ছে। বিধাননগরে এক একর জমিতে গড়ে উঠছে অত্যাধুনিক স্টুডিও। ভাল চিত্রনাট্য পেলে ফের প্রযোজনায় ফিরতে কোনও অসুবিধা নেই। বাংলা সিনেমার দর্শকদের কাছে শেষ নায়ক উত্তমকুমার। তাঁর ছবি এমন সুপারহিট হত না। ‘নায়ক’-এর মতো চিত্রনাট্য এবং উত্তমকুমার, ‘সন্ন্যাসীরাজা’-র চিত্রনাট্য এবং উত্তমকুমার। এই দুয়ের যুগলবন্দিতেই একটা ভাল সিনেমা তৈরি হত।’’
মূল প্রবেশ পথ।
বরাবরই তথ্যচিত্রের দিকে ঝোঁক ছিল আরোরার। ১৯০৬ সালে ‘ম্যাজিক থিয়েট্রিকাল কোম্পানি’ নামে পথ চলা শুরু হয়। পরে নাম বদলে হয় অরোরা সিনেমা কোম্পানি। জমিদারবাড়ি, মেলায় সেই সব নির্বাক তথ্যচিত্র দেখানোর ব্যবস্থা হত।
প্রথম কাহিনিচিত্র ‘রত্নাকর’। দেখানো হয়েছিল ভবানীপুরের রসা থিয়েটারে। একে একে হয়েছে ‘কেলোর কীর্তি’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘নিয়তি’। শুধু বাংলা নয়, তামিল, তেলুগু, উর্দু, ওড়িয়া ভাষাতেও ছবি প্রযোজনার ইতিহাস রয়েছে।
আরও পড়ুন, ইউনেস্কোর স্বীকৃতি এলেও কি বাঁচবে হেরিটেজ!
‘প্রহ্লাদ’ সিনেমাটি তখনকার সময়ে গ্রাফিক্সের জন্য সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ‘জলসাঘর’, ‘হরিশচন্দ্র’-র মতো সিনেমা দর্শকদের উপহার দিয়েছে অরোরা। ভগিনী নিবেদিতার শুটিং হয়েছিল লন্ডনে। ‘রাজা রামমোহন’, ‘আরোগ্য নিকেতন’ সিনেমার জন্য জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছে অরোরা।
আবার সেই ঋত্মিক ঘটকের মতো কাউকে খুঁজছে অরোরা। যার তথ্যচিত্র দেখে মনে হবে, তিনি সিনেমা বানাতে জানেন। তাই এখন সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা করা, নতুন ছেলেমেয়েদের সুযোগ দিচ্ছে আমাদের কোম্পানি। ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন তাঁরা। অঞ্জনবাবুর কথায়, “আমার ৫০ লাখ টাকা ক্ষতি হোক। কিন্তু বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগ অরোরা ফিরিয়েই আনবেই। নতুনদের ছবি এখন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রশংসিত হচ্ছে। সেই ছবিগুলিই এ বার এখানে দেখানোর ব্যবস্থা করব।”
অরোরা ফিল্মের বর্তমান কর্ণধার অঞ্জন বসু।— নিজস্ব চিত্র।
স্বপ্ন দেখতে চায় অরোরা ফিল্ম। স্বপ্ন দেখাতেও চায়। ১১৩ বছরের ঐতিহ্য বহন করে এনে সে এখন আরও সামনের দিকে তাকাতে চায়। ফিরিয়ে আনতে চায় বাংলা সিনেমার সেই স্বর্ণযুগ।
আর কে না জানে, স্বপ্নই তো এগিয়ে যাওয়ার পথ চেনায়! সুড়ঙ্গের শেষে উদ্দীপনার আলো দেখায়!
কলকাতা শহরের রোজকার ঘটনা, কলকাতার আবহাওয়া, কলকাতার হালচাল জানতে চোখ রাখুন আমাদের কলকাতা বিভাগে।